ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ভ্রাম্যমাণ কোনো দোকান বসানোর অনুমতি না থাকলেও তা বসিয়ে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্য মো. জুয়েল রানার বিরুদ্ধে।
গত ১৩ মার্চ (দ্বিতীয় রোজার দিন) সন্ধ্যা ৭টার দিকে অভিযুক্ত জুয়েল হাকিম চত্বরের ফুলের দোকানি সমতাজ বেগমের কাছ থেকে এই চাঁদা নিয়েছেন বলে ভুক্তভোগী নিজেই কালবেলাকে বিষয়টি সম্প্রতি জানিয়েছেন। এ সংক্রান্ত তথ্য কালবেলার হাতে রয়েছে।
লোকজনের আড়াল করতে চাঁদার এক হাজার টাকা জুয়েল গোলাপ ফুলের ভেতরে ভরে নিয়েছেন এবং অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো থেকেও প্রতিনিয়ত এভাবে মাসিক চাঁদা নেন বলে জানান তিনি। এ সময় তার কয়েকজন সহকর্মীও ছিলেন বলে জানান ভুক্তভোগী।
এদিকে গত কয়েকদিন আগে সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও হাকিম চত্বর এলাকায় ৫টি, টিএসসির ডাস চত্বরে ৪টি, টিএসসির জনতা ব্যাংকের এটিএম বুথের পাশে ৪টি, টিএসসির চায়ের দোকানের সামনে বিড়ি-সিগারেট ও পানের ৮টি, ঝালমুড়ির ২টি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূলফটক ও সামনের ফুটপাতে ৫টি, শামসুন্নাহার হল এলাকায় ২টি, শিব বাড়ির মোড়ে ২টি, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও কাজী মোতাহের হোসেন ভবন এলাকায় ৫টি, একাত্তর হল এলাকায় ৪টি ও এফ রহমান হল এলাকায় ১টিসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত অর্ধশতাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান চলছে।
জানা গেছে, ক্যাম্পাসে ভ্রাম্যমাণ যেকোনো দোকানপাট নিষিদ্ধ থাকলেও প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এ দোকানগুলো নিয়মিতই বসে এবং নির্দ্বিধায় বেচাবিক্রি করে।
এর আগে, গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রক্টরিয়াল টিমের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকায় অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়ে বছরে প্রায় অর্ধকোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগের সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সংবাদটিতে অভিযুক্ত জুয়েলসহ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত প্রক্টর কার্যালয়ের টোকেনম্যান শামীম হোসাইন, সেকশন অফিসার মো. রেজাউল করিম, প্রক্টরিয়াল টিম সদস্য মাসুদ রানা, হামিদুর রহমান, জহিরুল ইসলাম, মো. আবদুল্লাহ, মো. মিরাজ, মো. মেহেদী, আমিনুল ইসলাম, কৃষাণ, মো. সালাউদ্দিন ও মো. জাহিদের নাম উল্লেখ করা হয়। এরপর তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী ক্যাম্পাসের সকল ভ্রাম্যমাণ দোকান তুলে দেন। পরে অভিযোগ তদন্তে ওই বছরেরই ২ মার্চ তিন সদস্যের কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অবশেষে, চলতি বছরের এক সিন্ডিকেট সভায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় টোকেনম্যান মো. শামীম হোসাইনকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
চাঁদা নেওয়ার ঘটনায় অভিযোগ করে ফুলের দোকানি সমতাজ বেগম কালবেলাকে বলেন, এখানে (হাকিম চত্বর এলাকা) দোকান বসানোর কারণে প্রক্টরিয়াল টিমের জুয়েলকে আমার ১ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। জুয়েল দ্বিতীয় রোজার দিন সন্ধ্যায় আমার কাছ থেকে এই টাকাটা নেয়, তখন তার সঙ্গে প্রক্টরিয়াল টিমের আরও তিন-চারজন লোক ছিল। আমি তাদের নাম জানিনা। আর টাকাটা যখন সে নিয়েছে তখন তা গোলাপ ফুলের ভেতরে ভরে দিতে হয়েছে। চাঁদা নেওয়ার সময় লোকজন দেখবে বলে ফুলের ভিতর ভরে দিতে বলে সে।
তিনি বলেন, আমি ক্যানসারের রোগী। চিকিৎসার জন্য একজন আমাকে এই এক হাজার টাকা দিয়েছিল। সেটাই জুয়েলকে দিয়ে দিতে হয়েছে। জুয়েল আমার কাছে প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা করে চাঁদা চেয়েছে। চাঁদা দিলেই শান্ত থাকে, আর না দিলেই ঝামেলা করে, দোকানপাট ভেঙে ফেলে।
সমতাজ বেগম কালবেলাকে আরও বলেন, বইমেলা যখন চলছিল তখনও এখানে ফুলের দোকান চালানোর জন্য জুয়েল আমার কাছে চাঁদা চেয়েছিল, ওই সময় আমি টাকা দিতে পারিনি। যার কারণে, আমার দোকানের সবকিছু ভেঙে ১২০ পিস ফুল (প্রতি ফুলের ক্রয়মূল্য ১৫ টাকা) নিয়ে টিএসসির ডাস চত্বরের ফুলের দোকানদার পারভীন ও আলমের মায়ের কাছে বিক্রি করেছে। ডাস চত্বরের ফুলের দোকানদাররা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ক্যাম্পাসে গাঁজা ও ইয়াবা বিক্রি করে। তাদের কাছ থেকে জুয়েল ‘গাঁজা’ নিয়ে খায়। আর ক্যাম্পাসে যতগুলা দোকান আছে, এগুলো থেকে জুয়েলসহ প্রক্টরিয়াল টিমের কয়েকজন চাঁদা নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রক্টরিয়াল মোবাইল টিমের এক সদস্য বলেন, ক্যাম্পাসে দোকান বসানো বা চাঁদা তোলার মতো অপকর্মের সবগুলোই জুয়েল ও মাসুদের নেতৃত্বে হয়। এই দুজনের ওপরে টিমের কেউ কথা বলার সাহস পায় না।
ঘটনা প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে প্রক্টরিয়াল মোবাইল টিমের সদস্য অভিযুক্ত জুয়েল রানাকে বিগত কয়েকদিন যাবৎ কল দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, আমরা এই সমস্ত কর্মকাণ্ডকে বিন্দুমাত্রও প্রশ্রয় দেই না। যদি এ রকম হয়েই থাকে বা সে যদি এই কাজ করেই থাকে অথবা এটা যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে আমাদের প্রক্টোরিয়াল বিধিবিধান অনুযায়ী অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন