এক অধ্যাপকের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১২তম ব্যাচের ফলাফলে ভয়াবহ ‘ধস’ নেমেছে বলে অভিযোগ করা হয় গত বুধবার। এই অভিযোগের তিন দিনের মাথায় এবার ওই একই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন একই বিভাগের এক শিক্ষার্থী। অভিযুক্ত ওই অধ্যাপকের নাম ড. নাদির জুনাইদ।
শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ওই শিক্ষার্থী। লিখিত অভিযোগে ওই শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষক নাদির জুনাইদ তাকে প্রায়ই অরুচিকর কথাবার্তা বলতেন। রাতে কল করে নানা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও বলতেন। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রস্তাবও দিতেন।
তবে এ ব্যাপারে ড. নাদির জুনাইদ কালবেলাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে দুরভিসন্ধি হচ্ছে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আগামী জুনে আমার বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল, সেটা ঠেকানোর এটা একটা কৌশল।
তিনি বলেন, এর আগে অভিযোগ উঠল আমি শিক্ষার্থীদের নম্বর কম দিয়েছি। কিন্তু ওই খাতা আমার হাতে ছিল না। বোর্ডে চারজন শিক্ষক ছিলেন। নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অন্য কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেনি।
যৌন হয়রানির অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে টার্গেট করে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আমি যাতে বিভাগের চেয়ারম্যান হতে না পারি সে চেষ্টা করা হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হতে পারে- এটা আগেই খবর পেয়ে আমি শুক্রবার শাহবাগ থানায় একটি জিডিও করেছি। তবে অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেভাবে গণমাধ্যমে নিউজ করা হচ্ছে, তাতে আমি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হচ্ছি। সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি। দু-এক বছর পরে হয়ত এ অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হবে, তখন আমার এই ক্ষতি কে পূরণ করবে।
২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়া এই অধ্যাপক জানান, শনিবার বিকাল পর্যন্ত ঢাবি কর্তৃপক্ষ তার কাছে অভিযোগের বিষয়ে কিছু জানায়নি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, আমি সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীর অভিযোগ পেয়েছি। ওই শিক্ষার্থী এটা উপাচার্য মহোদয়কেও হয়তো দিবে। উনি (উপাচার্য) গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আছেন। রোববার সকালে তা হাতে পেলে সিদ্ধান্ত নিবেন হয়ত।
প্রক্টর মো. মাকসুদুর রহমানের কাছে দাখিল করা অভিযোগে প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে তার ওপর নজরদারি করা, সময়ে অসময়ে ফোন করা, যৌন ইঙ্গিত দেওয়াসহ নানা অভিযোগ এনেছেন ওই ছাত্রী।
ওই শিক্ষার্থী লিখেছেন, এই সময়ে ওই শিক্ষক অনুষদ বিভাগের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বিষয়ে-বিভাগের কমিটির সিদ্ধান্ত, পরীক্ষার ফলাফল এমনকি শিক্ষকদের আচরণ সম্পর্কেও তার সঙ্গে কথা বলেছেন।
ওই শিক্ষার্থী আরও লিখেছেন, ‘তিনি তার রোমান্টিক আলাপ-আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক নাদির বিভাগে ব্যাপক ক্ষমতাধর হওয়ায় ভয়ে তিনি পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ করতে পারেননি।’
তিনি বলেন, ‘গত দেড় বছর ধরে আমি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেছি। দুর্ভাগ্যবশত, এই যন্ত্রণা সরাসরি তার কাছে প্রকাশ করা আমার পক্ষে চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হয়েছিল। মানসিক চাপের তীব্রতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, আমি ঘুমাতে পারতাম না, রাতে অনিদ্রায় ভুগতাম। পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমি গত বছরের শুরুতে কাউন্সেলিং করেছিলাম এবং এমনকি আমাকে ঘুমের ওষুধের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ওই ছাত্রী আরও লিখেছেন, তিনি সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করার চেষ্টা করলে অধ্যাপক নাদির শ্রেণিকক্ষে প্রকাশ্যে তাকে তিরস্কার করেন।
শিক্ষার্থীর অভিযোগ, ‘তিনি বারবার বলেন, আমি ‘স্বাভাবিক’ নই এবং আমার চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া উচিত। তার চাপ ক্রমাগত বাড়ছিল। তিনি আমার অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বারবার জিজ্ঞাসা করেন কেন আমি তার রোমান্টিক আলাপে সাড়া দিই না। এটি মৌখিক নির্যাতনে পরিণত হয়েছিল। তিনি আমাকে ‘নির্বোধ’ বলে তিরস্কার করেছিলেন এবং আমাকে ‘অনুভূতিহীন’ বলতে থাকেন।
তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি লাগাতার যৌন হয়রানি সহ্য করেছি, তার কর্তৃত্বের অবস্থানের কারণে নিজেকে দুর্বল মনে করেছি। এ বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। এটিকে আমি কেবল ব্যক্তিগত আগ্রাসন হিসেবে বর্ণনা করতে পারি।’ অভিযোগে টেলিফোনে নানা ধরনের যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য, ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেসসহ নানা বিষয় তুলে ধরেছেন।
এর আগে গত বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় উপাচার্যের বাসভবনে গিয়ে অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের হাতে কয়েকজন শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আমরা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। আমাদের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারের কোর্সের সমন্বয়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। ফলে তিনি স্নাতকোত্তর পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও সমন্বিত কোর্সের (এমসিজে-৫২৭) প্রথম পরীক্ষক ছিলেন। একইসঙ্গে ওই কোর্সের ভাইভা বোর্ডেও ছিলেন তিনি।
স্নাতক পর্যায়ের ফলাফলে প্রথম ১০ জনের (যারা ভালো ফলের জন্য অধ্যাপক সিতারা পারভীন পুরস্কার লাভ করেছেন) মধ্যে ছয়জন স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে মাত্র একজন সর্বোচ্চ ২.৭৫ পেয়েছেন। অন্যরা পেয়েছেন ২.৫০-এরও নিচে। সমন্বিত কোর্সে এমন ফল বিপর্যয় এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এই ফল আমাদের সবাইকে হতবাক করেছে। স্বয়ং বিভাগের শিক্ষকরাও একে ‘নজিরবিহীন’ বলছেন। অভিযোগপত্রের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাচের ২৮ জন শিক্ষার্থীর সই যুক্ত করেন। অভিযোগটি আমলে নিয়ে উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছারের কাছে শিক্ষার্থীদের পাঠান উপাচার্য।
মন্তব্য করুন