মহিম নাকি সুরেশ! অচলা আসলে কাকে চায়? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে ত্রিভুজ প্রেমের দোলাচলের এ সমাপ্তি পাঠক কখনই খুঁজে পাবেন না। পাবেন শুধুই ভারসাম্যহীনতা। কিন্তু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ অরণ্যে ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের সাথে ব্যক্তির প্রশান্ত মনের নির্মলতায় পড়ালেখার এক অভিনব ভারসাম্য সৃষ্টি করে এ বিদ্যাপীঠ।
বধ্যভূমির ওপর অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল পদ্ম ও শাপলা যেন তাজা রক্তে ভেজা পবিত্র শহীদদের কথা স্মরণ করে। ফুলের ওপর উড়তে থাকা প্রজাপতিগুলো যেন সেই সব শহীদদের অমর আত্মা।
১০৬ একরজুড়ে বিস্তৃত এই ক্যাম্পাসে এক এক পা বাড়ালেই পড়ালেখার এক ঔজ্জ্বল্য পরিবেশের সাথে প্রাকৃতিক আশ্চর্যের সুরেলা মিশ্রণ উপলব্ধি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশের পুকুরের টলমলে পানি ও লাল শাপলার সতেজতা শুভ সকালের জানান দেয়। ফটক থেকে প্রবেশ করতেই কালজয়ী মুজিব ম্যুরালের সম্মুখ ফুলের গাছ ও প্রশাসন ভবনের পাশের বিভিন্ন ফুলের গাছ যেন সকলকে সমাদরে বরণ করে নেয়। লাল, হলুদ ফুলের সৌন্দর্য যেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভিবাদন জানায়।
একটু সামনে যেতেই চোখে পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুকুট রত্ন মন্ত্রমুগ্ধ হ্রদ লালন লেক। জলের এই নির্মল শরীর ক্যাম্পাসে নির্মলতার ছোঁয়া যোগ করে শিক্ষার্থীদে পাঠদানেও। হ্রদটি মনন, অবসরে হাঁটা এবং ছায়াঘেরা পরিবেশের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান হিসাবে কাজ করে। লেকের পাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ওয়াকওয়ে। ওয়াকওয়ে যেন ক্যাম্পাসের নান্দনিকতাকে শতগুণ বৃদ্ধি করেছে। লেকের পাশ দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন গাছ। সুন্দরবনের বিভিন্ন জাতের গাছগুলো স্বীকার করাতে বাধ্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে মিনি সুন্দরবন। রাতের বেলার শান্ত পরিবেশে ক্যাম্পাসে থাকা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ আপনাকে অন্যভুবনে নিয়ে যাবেই।
পাশে বাঁশঝাড়। তার বিপরীত পাশে পদ্ম ও শাপলা ফোটা ছোট পুকুর। পেছন দিকে হোগলাবন। চারদিক খোলা। সামনে ও পেছনের অংশ প্রায় ত্রিভুজের মতো দেখতে। একে কোনো ঘর, আবার ছাউনি দেওয়া চালাও বলা যায় না। প্রকৃতির কাছাকাছি গ্রামীণ পরিবেশে সুন্দরবনের গোলপাতায় এমনই এক ব্যতিক্রমধর্মী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাফেটেরিয়া। সবুজে ঘেরা চারপাশ, তার ভেতরে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে গোলপাতার ছাউনি। সমস্ত দিনের শেষে সকল হাসি,আড্ডা, আনন্দ ও ক্লান্তি জমা হয় এ ক্যাফে। প্রযুক্তির সঙ্গে প্রকৃতি কচুরিপানার পদ্ম শাপলায় আপনার চোখ আটকাবেই। কারও আবার মনে পড়তে পারে শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলোর কথা, যখন মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বকুনির ভয়কে উপেক্ষা করে খালে-বিলে কলার ভেলা, তালের ডোঙা অথবা ছোট্ট নৌকায় চেপে শাপলা বা কচুরিপানা ফুল তোলার স্মৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য বাংলা সংলগ্ন সৃষ্ট নতুন জলাশয়ের অগভীর পানিতে সেই রক্ত শাপলার চোখ জুড়ানো হাসির দেখা মিলল। শুধু ফুলই নয় বরং ফুটন্ত ফুলের পাশে আরও কলি পানি থেকে মাথা বের করে পূর্ণ ফুল হয়ে ফোঁটার প্রহর গুনছে। ভোরের সূর্যের আলোয় ফুটন্ত শাপলার চোখ জুড়ানো হাসি আশপাশের পরিবেশকে যেন আরও আলোকিত করে দেয়। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পরিবেশকে আরও আপন করে নেবার আয়োজন স্পষ্টত উপচে পড়ছে। প্রকৃতি যেন তার নিজ হাতে ফুটন্ত লাল শাপলার হাসিকে সাজিয়ে দিয়েছে।
পাখির কিচিরমিচির শব্দ, সবুজ গাছগাছালির ছায়ানিবিড় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুলফটক থেকে সোজা তাকালে দৃষ্টি আটকে যাবে অদম্য বাংলা ভাস্কর্যে। সড়কের দুপাশে রয়েছে নানা ফুলের ও বকুলের গাছ। ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা মিষ্টি পরিবেশ যেন প্রতি মুহূর্তে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানের কাশফুল, শিউলিফুল যেন অপরূপ শুভ্রতা দান করে। হেমন্তের মৃদু কুয়াশা, শীতের বাতাস ক্যাম্পাসের বুকে শীতের আগমনী বার্তা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো সাজানো আছে নানা গাছগাছালি ও ফুলের সমারোহে। রাস্তার পাশ দিয়ে অসংখ্য নারিকেল গাছ সাথে রয়েছে বকুলের। এ ছাড়াও এই ক্যাম্পাসে এক ধরনের হলুদ ফুল ফোটে যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতির জন্য পাখি, গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি। এই ক্যাম্পাসের পাখিগুলো বেশ নিরাপদ। পাখিদের অবাধ বিচরণ, নিরাপদ আশ্রয় তৈরি ও তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি বসানো হয়েছে। আপনমনে তারা এদিকে ওদিকে উড়ে গান করে বেড়ায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ছোট-বড় বেশকিছু পুকুর, জলাশয়। চাঁদের আলোয় জলাশয়ের পানি ঝলমল করে। মুক্তমঞ্চের সামনের দিকে থাকা শ্বেতকাঞ্চন ও কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য আপনাকে মোহিত করবেই। শুধু তাই নয়, ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে অসংখ্য কাঞ্চন, জারুল, পলাশ গাছ। মন্দিরের পাশে ও ওয়াকওয়ের মাঝের গাছগুলোতে সারাদিন পাখি কলকাকলি শোনা যায়। ক্যাম্পাসে রয়েছে অসংখ্য ফলের গাছ, নারিকেল, আম, কামরাঙা, জাম্বুরা, কাঁঠাল, জাম আরো কত কি! পুরো ক্যাম্পাসটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এমনভাবে সাজানো যেন আপনাকে বারবারই মনে করিয়ে দেবে ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না।’ প্রকৃতি প্রেমীরা একটু শান্তির খোজে ছুটির দিনে বেছে নেয় এ-ই ক্যাম্পাসকে। গাছের সবুজ ছায়া ও নির্মল বাতাস শিক্ষার্থীদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। এক কথায় বলতে গেলে, ‘জীবন যেথায় হারিয়ে যায়, অবারিত সবুজের নিলীমায়। ফুল-পাখির আর স্বপ্নের দেশে।’
মাস্টার প্লানে ক্যাম্পাসে গত কয়েক মাসে নতুন করে দুই সহস্রাধিক বিভিন্ন গাছ রোপণ করা হয়েছে। যা বছরে প্রায় ১১ হাজার ৮০০ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারবে। আগামী ১০ বছর পর এ গাছগুলো বছরে প্রায় ৪৪ হাজার কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারবে।
সুসজ্জিত লাইব্রেরি হল জ্ঞানের ভাণ্ডার, যা ছাত্রদের বই, জার্নাল এবং ডিজিটাল সম্পদের বিশাল সংগ্রহ প্রদান করে। প্রকৃতির সৌন্দর্যর সাথে ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা যে সুসংগতভাবে সহাবস্থান করতে পারে তার প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
বালু দিয়ে ব্যতিক্রমী শিল্প গড়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় শিক্ষা নেওয়া সত্যানন্দ প্রকৃতির রূপ-রঙ-আবহকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। রঙের সঙ্গে আঠা মিশিয়ে তাতে বালু দিয়ে বিভিন্ন তাপমাত্রায় ফুটিয়ে তুলেছেন নদী, গাছপালা, খেলার মাঠ, পথ-ঘাট ইত্যাদি। শিক্ষাভূমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতির সঙ্গে অন্ত্যমিল খুঁজে ফিরেছেন তরুণ চিত্র শিল্পী সত্যানন্দ পাইক।
প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা নানা উপাদান মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে। সবুজ অরণ্যে হাঁটা বা রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে ক্যাম্পাসে ছুটতে যাওয়ার মাধ্যমে সুখ এবং শান্তির অন্তর্নিহিত অনুভূতি জাগ্রত করতে পারাটা নিছক কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাপার নয়। নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আর প্রকৃতির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। খুব গোপনে সখ্যতার সাথে এ আধয়্যাত্মিক কাজগুলো করে যাচ্ছে এ ক্যাম্পাসটি।
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক সাধন চন্দ্র স্বর্ণকার বলেন, প্রকৃতির সাথে মানুষের বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের এক গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নান্দনিক প্রাকৃতিক শোভা ও মনোরম পরিবেশ শিক্ষার্থীদের শুধু উদ্বেলিত করে না, এখানকার গাছের সারি, ফুলের সমারোহ, ভোরের সৌন্দর্য, পাখির কলতান, গোধূলির আভা আর নির্মল বাতাস এক অনাবিল মুগ্ধতা যেন সবার মন জুড়িয়ে দেয়। পরিবার পরিজন ছেড়ে আসা কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীরা তাই খুব অল্প সময়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের আপন মায়ায় জড়িয়ে ফেলে, মাঝে মাঝে একঘেয়েমি জীবন ও একাডেমিক ব্যস্ততার বোঝা নিমেষেই ভুলে যায় প্রাকৃতিক শোভাময় ছোট ছোট গল্প, গান কিংবা আড্ডার আসরে। পড়াশোনা ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রামী সন্ধীক্ষনে যে মননশীল বিকাশ দরকার তার একটা বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করে শিক্ষক শিক্ষার্থী সবার প্রাণের প্রিয় সবুজে ঘেরা গ্রামীন আবহময় এই ছোট ক্যাম্পাস আঙিনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস জানান, যে কোনো কাজ করবার আগে আমাদের মাথায় আসে পরিবেশবান্ধব। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার পাশাপাশি যে প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন- লেকের লাল শাপলা, নতুন ক্যাফেটেরিয়া যা গ্রাম বাংলার আবহাওয়া তৈরি করছে, পাখিদের জন্য গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি স্থাপন, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্লান্ট, গ্রিন ক্লিন সেফ বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ যেখানে থাকবে বুদ্ধিদীপ্ত টেকসই, ক্যাশলেস, পেপারলেস, গ্রিন ক্লিন ও প্রযক্তির সাথে প্রকৃতির এক মিল বন্ধন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন।
মন্তব্য করুন