উপচার্য ও উপ-উপচার্যের অব্যাহতির সিদ্ধান্তের পর বুধবার গভীর রাত থেকেই ক্যাম্পাসে উল্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) সকাল থেকেই মিষ্টি বিতরণ ও বিকেল ৪টায় ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল করেন সহস্রাধিক শিক্ষার্থী।
তবে শিক্ষক সমিতি বলেছে- সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া চাপের মুখে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অব্যাহতির সিদ্ধান্তে ন্যায়বিচারের পরাজয় হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ছিল শান্ত। শিক্ষার্থীরা সবাই হলে ফিরে গেছে। দুপুরের পরপর ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন শিক্ষকরাও। তবে শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বলে মনে করেন অনেকে।
ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল ও শিক্ষার্থীদের উল্লাস গতকাল বুধবার রাত ১২টার পর থেকে খবর আসতে থাকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ড. মু. মাছুদ এবং উপ উপচার্য অধ্যাপক ড. মো. শরিফুল ইসলামের অব্যাহতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- কুয়েটে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সংকট নিরসন এবং শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। অনতিবিলম্বে একটি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ দুটি পদে নতুন নিয়োগ প্রদান করা হবে।
এই বিজ্ঞপ্তির পর থেকে আনন্দে ভাসতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। বিকেলে হাজারো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বিজয় মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। জাতীয় পতাকা এবং কারও কারও হাতে ফিলিস্তিনির জাতীয় পতাকা দেখা যায়। এসময় বিজয় মিছিলে শিক্ষার্থীরা স্লোগানে বলেন, ‘রাজনীতির আস্তানা, কুয়েটে হবে না’, ‘শিক্ষা-সন্ত্রাস একসঙ্গে চলে না’, ‘এই মুহূর্তে খবর এল স্বৈরাচারের পতন হলো’ -এসব নানান স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন শিক্ষার্থীরা।
এমটি ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান কালবেলাকে বলেন, এই ভিসি তার চেয়ারকে কলুষিত করেছেন। ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি প্রবেশ করাতে শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে খেলা করেছেন। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন। বহিরাগতদের শিক্ষার্থীদের নাম-ঠিকানা সরবরাহ করে মামলা করিয়েছেন। আবারও ৩৭ সাধারণ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারও করেছেন। ফলে এই প্রশাসন নতজানু এবং প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই তিনি কুয়েটের ৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর মনের বাসনা বুঝতে পেরেছেন। সন্ত্রাস ও শিক্ষা একই সঙ্গে হয় না।
শিক্ষক সমিতির বিবৃতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) সংঘর্ষ ও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় দোষীদের বিচার না পর্যন্ত ক্লাসে ফিরবেন না শিক্ষকরা। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ক্যাম্পাসের দুর্বার বাংলার সামনে সাংবাদিকরা কুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতি ও শিক্ষক সমিতির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এসব কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. ফারুক হোসেন।
এসময়ে তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটানোয় যারা দোষ করেছে, এ ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে অপসারণ দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অপরাধ যেটা সেটা অপরাধই, সেটা আমাদের ছাত্রদেরও দাবি শিক্ষকদেরও দাবি। আমাদের পরিষ্কার অবস্থান এই বিচার নিশ্চিত করেই তবে ক্লাসে ফিরতে হবে। তা না হলে শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত হবে না।
একই সঙ্গে তিনি ভিসি ও প্রোভিসিকে অপসারণে ইউজিসির তদন্ত নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা এসেছিলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে, অনুরোধ করতে। শিক্ষার্থীদের আমরা অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছি। উপদেষ্টার প্রতিনিধিদল (ইউজিসির সদস্য) তারাও এ ব্যাপার আমাদের নিকট অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তবে এখন আমরা দেশের পরিস্থিতি জানি, এ পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সমিতি উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় স্বার্থে আমরা সবাই একাত্মতা প্রকাশ করে যাব। ভিসি-প্রোভিসির অপসারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এই অপসারণ হয়নি বলে আমরা মনে করি।
বর্তমানে ক্যাম্পাসে শান্তিমূলক পরিবেশ বজায় আছে বলে জানিয়েছেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে এখন শান্তিমূলক পরিবেশ বজায় আছে। গেটে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ছাত্ররাও কোনো আন্দোলনে নেই। আর নিরাপত্তা নিয়েও কোনো হুমকি নেই।
অব্যাহতি মানতে পারছেন না উপ-উপাচার্য খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপ-উপাচার্য শেখ শরীফুল আলম বলেছেন, আমি গতকাল রাত ১০টায় ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছি। তবে কোনো কাগজে স্বাক্ষর করিনি। এটা অব্যাহতি হতে পারে। কিন্তু আমি পদত্যাগ করিনি বা আমাকে পদত্যাগ করতে বলাও হয়নি। আমাদেরকে যদি বলতো ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে আপনাদেরকে পদত্যাগ করতেই হবে, এটাই একমাত্র সমাধান। তাহলে আমরা পদত্যাগ করতাম। আমি কোনো পদত্যাগপত্র পাঠায়নি। তিনি বলেন, ইউজিসির টিম গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন। বেশিরভাগ সময় ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমার সঙ্গে কথা বলেছেন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। ১৮ ও ১৯ তারিখের ঘটনা বিষয়ে কথা হয়েছে। তাদের কোনো প্রশ্নই আমার কাছে মনে হয়নি যে আমার কোনো একটা জায়গা থেকে ত্রুটি বা স্বচ্ছতা, নিষ্ঠার অভাব আছে। প্রতিষ্ঠান বা ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করছি। তবে আমি বুঝতেই পারছি না যে আসলে আমার অপরাধটা কী?
এর আগে অব্যাহতি দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকা এবং অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কুয়েটের উপ-উপাচার্য শেখ শরীফুল আলম। শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর লেখা ওই চিঠিতে অধ্যাপক ড. শেখ শরীফুল আলম লিখেছেন, জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখি। পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর আমাকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। উপ-উপাচার্য পদে যোগদানের পর বিভিন্ন দাপ্তরিক সভা ও সিন্ডিকেটে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। যোগদানের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাকে কোনো প্রশাসনিক ও আর্থিক কাজে সহযোগিতা করেননি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়া এবং কোনো অপরাধ/অপকর্ম না করে অব্যাহতি দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুল বার্তা যাবে বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যকে অব্যাহতি দেওয়ার মতো পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি বা অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
মন্তব্য করুন