খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) হামলার ঘটনার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয় কুয়েট কর্তৃপক্ষ। এরই মাঝে রোজা এবং ঈদের ছুটি মিলিয়ে ৫০ দিন বন্ধের পর খুলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। আগামী ১৫ এপ্রিল দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েছে কুয়েট কর্তৃপক্ষ।
তবে এখনই অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। এ জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আনিছুর রহমান ভূঞার স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এদিকে, কুয়েট প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে প্রহসনমূলক আখ্যা দিয়ে আগামী রোববার (১৩ এপ্রিল) একসঙ্গে হলে ওঠার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ‘কুয়েট ১৯’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে শিক্ষার্থীরা এ ঘোষণা দেন। ওই পেজ থেকে কুয়েট শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্রদল ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ৯৯তম (জরুরি) সভায় সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আনিছুর রহমান ভূঞার স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রেক্ষিতে সিন্ডিকেটের ৯৯তম জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও আবাসিক হলগুলো পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ আছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্তরিক। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের অপূরণীয় ক্ষতির কথা মাথায় রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে কর্তৃপক্ষ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থী ও সম্মানিত অভিভাবকদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হবে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে অতি দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু ও হলগুলো খোলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আশাবাদী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে ইন্টারনেট ও পানির সংযোগ বন্ধ করে তাদেরকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। হল বন্ধ থাকার কারণে অনেকের একমাত্র আয়ের উৎস টিউশন হারাতে বসেছে। কুয়েটের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষ হয়ে এতদিনে চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার কথা, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থার কারণে তাদের পরীক্ষা আটকে আছে বলে জানান ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কুয়েটে সন্ত্রাসী হামলার দেড় মাস হতে চলল কিন্তু একজনকেও গ্রেপ্তারের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীরা সামান্য আয় রোজগারের জন্য ক্যাম্পাসে ফেরত গিয়ে হলে থাকতে চাইলে শিক্ষার্থীদেরকে পুলিশ দিয়ে হলে প্রবেশ করতে বাধা পর্যন্ত দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের ফোনে মেসেজ দিয়ে হুঁশিয়ার করা হয়, যেন তারা সন্তানকে ক্যাম্পাসে না পাঠায়।
এদিকে ‘কুয়েট ১৯’ ফেসবুক পেজে এক পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘কুয়েটের হল কমিটি, সব বিভাগের ভিপি ও সিআরদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১৩ এপ্রিল নিরাপদ ক্যাম্পাসের প্রত্যাশায় আমরা আমাদের কুয়েট ক্যাম্পাসে প্রত্যাগমন করব এবং সবাই একসঙ্গে হলে উঠব।’
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সব শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ জেলা অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংঘবদ্ধভাবে ক্যাম্পাসে আসার আহ্বান জানানো হয় ওই ফেসবুক পোস্টে।
এদিন আরেক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান প্রশাসনকে কুয়েটিয়ানরা পরিহার করেছে। কুয়েটিয়ানদের ১৩ এপ্রিল হলে ফেরার ঘোষণার মুখে প্রশাসন থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিকে আমরা পরিহার করছি। ১৩ এপ্রিল সারা দেশ থেকে কুয়েটিয়ানরা তাদের নিজ নিজ হলে ফেরত আসবে।’
শিক্ষার্থীরা জানান, কুয়েটের উপাচার্যের অপসারণ ও হামলাকারীদের গ্রেপ্তারসহ ৬ দফা দাবি জানিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তাদের সেই দাবি পূরণ হয়নি। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম কবে শুরু হবে এবং কবে হল খুলবে তা অনিশ্চিত। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়ালি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে আগামী ১৩ এপ্রিল সবাই এক সঙ্গে ক্যাম্পাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রয়োজনে তারা প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে ফিরবেন। বিষয়টি জানার পর তৎপর হয়ে উঠেছে কুয়েট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে কুয়েটের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক শেখ শরীফুল আলম কালবেলাকে বলেন, দাপ্তরিক কার্যক্রম ১৫ এপ্রিল শুরু হবে, এটা আগেই সিদ্ধান্ত ছিল। আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তী নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেটে হয়েছে; তাই সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমেই এ দুই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
এদিকে, ক্যাম্পাসে ফিরতে কুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার রাতে খুবি শিক্ষার্থীদের ফেসবুক পেজ কেইউ ইনসাইডার (KU Insiders) থেকে এই সমর্থন জানানো হয়। কেইউ ইনসাইডার এর ওই ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, দেড় মাস হয়ে গেলেও কুয়েট শিক্ষার্থীদের হলে ফেরানোর বিষয়ে কোনো চিন্তা নেই কুয়েট প্রশাসনের। এদিকে শিক্ষার্থীদের নিজ ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দেওয়ার জন্য থানায় পুলিশ মোতায়েনের দরখাস্ত করেছেন প্রশাসন। পাশাপাশি প্রত্যেক গার্ডিয়ানের ফোনে মেসেজ ড্রপ করেছেন যেন তাদের সন্তান ঘরে থাকে।
খুলনার সাধারণ জনতা ও খুলনার সকল শিক্ষার্থীদের উচিত কুয়েটের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। আমরা টিম KU Insiders পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি কুয়েটের সব শিক্ষার্থীরা যেন দ্রুত ক্যাম্পাসে ফিরতে পারে।
প্রসঙ্গত, ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। পরের দিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব অ্যাকাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই দিন খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনকে লাল কার্ড দেখান শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা খুলনা থেকে ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেন। এতে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার, উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানানো হয়।
মন্তব্য করুন