শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জোরপূর্বক গুমের শিকার হওয়া অনেক ব্যক্তি তাদের পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আসাদুজ্জামান রানা এবং আল আমিন নামের তিনজন শিক্ষার্থী ১১ বছর পরেও নিখোঁজ রয়েছেন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বরে শেষবারের মতো তাদের দেখা পেয়েছিল প্রিয়জনরা।
তাদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বেসামরিক পোশাকে একদল লোক ওই দিন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ছয়জনকে তুলে নিয়ে যায়। যার মধ্যে এই তিনজনও ছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন বলে জানা গেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের নিখোঁজের ঘটনায় কোনো ধরনের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
তাদের অপহরণের সময় এই তিনজনই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বছরের পর বছর ধরে অনুসন্ধান চালানোর পরেও তাদের পরিবার তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য পায়নি।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীরা সবাই ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। রাসেল এবং আল আমিন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এবং রানা দর্শন বিভাগে অধ্যয়নরত ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, শিক্ষার্থীদের কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড ছিল না এবং শুধু তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। পরিবারগুলো জানায়, অপহরণকৃত শিক্ষার্থীদের খুঁজে পেতে একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিলো এবং র্যাব ও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। তারপরেও তারা প্রশাসনের কাছ থেকে ন্যূনতম পরিমাণ সহযোগিতা পায়নি। উল্টো মামলা প্রত্যাহারের জন্য তাদের চাপ দেওয়া হয়েছিল।
মাজহারুল ইসলাম রাসেলের বড় ভাই মশিউর রহমান কালবেলাকে জানান, তার পরিবার পক্ষাঘাতগ্রস্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। মশিউর বলেন, রাসেল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নিপীড়নমূলক শাসনামলে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। আমরা জানি না সে বেঁচে আছে কি না।
আল আমিনের ছোট ভাই রুহুল আমিনও একই ধরনের কষ্টের কথা জানান। তিনি বলেন, তার ভাই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার কারণে ভাইভা দিতে পারেননি।
তিনি আরও বলেন, আমরা ভাটারা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলাম, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমরা অজ্ঞাত নম্বর থেকে হুমকিও পেয়েছিলাম। তাই আমরা আমাদের মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছি।
আসাদুজ্জামান রানার বড় বোন মোছা. মিনারা বেগম তার ভাইয়ের নিখোঁজের বিষয়ে তার পরিবারে নেমে আসা শোকাবহ বেদনার কথা কালবেলায় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রানা একজন ভালো ছাত্র ছিল এবং কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে আমাদের পরিবারের ও দেশের জন্য সম্পদ ছিল। আমরা তাকে সর্বত্র খুঁজেছি কিন্তু খুঁজে পাইনি। আমরা জোরপূর্বক গুম তদন্তের জন্য গঠিত সরকারি কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কোনো আপডেট দিতে পারেনি। আমরা এখনও আশা রাখি যে আমরা আমার ভাইকে ফিরে পাব।
এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিজম তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম স্বৈরশাসক হাসিনার আমলে বিরোধী দল ও মত নিধনে গুম, খুন, হয়রানি ছিল বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের প্রহসন। এ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের তিন মেধাবী ছাত্রনেতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রানা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মাজহারুল ইসলাম রাসেল এবং যুগ্ম সম্পাদক মো. আল-আমীন। মূলত বিএনপির ডাকা সেদিনের অবরোধ কর্মসূচির প্রস্তুতির সময় বসুন্ধরা আই ব্লক থেকে কিসমৎ হায়াতের নেতৃত্ব র্যাব-১ এর তিনটি গাড়ি এসে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। শুরুতে স্বজনদের নিকট গ্রেপ্তার জানানো হলেও, পরবর্তীতে র্যাব, ডিবি এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার বরাবর বারবার যোগাযোগ করার পরেও ভাইদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আজও আমরা তাদের খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ সালের এই ঘটনার প্রতি তীব্র নিন্দা জানাই এবং বিরোধী মত দমনের এই অপকৌশলকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানাই।
আমরা বর্তমান প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই যে, তারা আমাদের নিখোঁজ ভাইদের সন্ধান করার উদ্যোগ গ্রহণ করুক এবং সুষ্ঠু তদন্তের সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসুক।
মন্তব্য করুন