আর্থিক কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে ভিসি ও কোষাধ্যক্ষকে বিমান বিলাস করাতেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশন।
গত বছর বার্ষিক পিকনিকে কুবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন ও সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামানকে ঢাকা-কক্সবাজারে বিমানে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাকির হোসেন ও সেক্রেটারি মোহাম্মদ ছাদেক হোসেন মজুমদার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর ১৪ মার্চ (কুমিল্লা-কক্সবাজার) পিকনিকের আয়োজন করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশন। পিকনিকে মোট খরচ হয় ৫ লক্ষ ৩০ হাজার ৮শত ৫০ টাকা। এর মধ্যে ভিসি ও কোষাধ্যক্ষের বিমান ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, হোটেল সি-গাল ও টিউলিপে রুম বরাদ্দ, আপ্যায়ন বাবদ খরচ হয় ৭১ হাজার টাকা। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন অনেক কর্মকর্তা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্যান্য বছর পিকনিকে বরাদ্দ দেয় ৫০-৮০ হাজার টাকা। কিন্তু গতবার ২২ জন কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ দেয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। পরে কর্মকর্তাদের পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ট্রেজারার ও তার পরিবারসহ সর্বমোট ৬৫ জন অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের জন্য যে বরাদ্দ দিয়েছে পিকনিক কমিটি সেই অর্থ স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ব্যয় করেছে।
কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. মোশারফ হোসেন বলেন, আমরা ৭০-৮০ জন কর্মকর্তা নিয়ে পিকনিক করেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ৮০-৯০ হাজার টাকার বেশি পাইনি। অথচ এবার মাত্র ২২ জন কর্মকর্তা নিয়ে পিকনিক আয়োজন করে প্রশাসন থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তৎকালীন উপাচার্যের সাথে সিন্ডিকেট করে তারা এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর বিনিময়ে ভিসি ও ট্রেজারারকে ঢাকা থেকে বিমানে কক্সবাজারে যাতায়াত করানো হয়েছে। এছাড়াও মাত্র ২২ জন কর্মকর্তা (অতিথিসহ মোট ৬৫ জন) নিয়ে কক্সবাজারে ১ রাত্রি অবস্থান করে পাঁচ লক্ষ ত্রিশ হাজার আট শত পঞ্চাশ টাকা ব্যয় দেখানো সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত ও বিবেকবর্জিত কাজ। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তদন্তপূর্বক তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এএফএম আবদুল মঈনের দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গাওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করার জেরে ২ আগস্ট ‘দৈনিক যায়যায়দিন’ পত্রিকার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইকবাল মনোয়ারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সংবাদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও ইকবাল মনোয়ারের স্থায়ী বহিষ্কার চেয়ে মানববন্ধন করেন কর্মকর্তারা। প্রতিবেদকের কাছে আসা ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অনেকে কোনো কারণ না জেনেই ইকবালের স্থায়ী বহিষ্কার ও কুবিসাসের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন। এ কারণেই কর্মকর্তাদের পিকনিকে ১ লাখ ২০ টাকা বেশি দেন ভিসি।
ভিসি ও কোষাধ্যক্ষের বিমান বিলাস সম্পর্কে পিকনিক কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ সোহাগের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সভাপতি-সেক্রেটারি যে নির্দেশনা দিয়েছিল তা আমরা বাস্তবায়ন করেছিলাম।
ভিসি ও কোষাধ্যক্ষকে বিমান বিলাস করার কোনো নিয়ম কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই রকম কোনো নিয়ম নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তাই আয়োজন করা হয়েছিল।
এছাড়াও আগের প্রশাসন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরিও অ্যাসোশিয়েনের টাকা দিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। তবে তার অভিযোগ প্রত্যাখান করেন তৎকালীন কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জিনাত আমান। তিনি বলেন, ভিসি স্যার নিজে ৫ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়াও বিমান ভাড়ার টাকা স্যার নিজে দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান বলেন, অনেকদিন আগের বিষয় আমার তো মনে নাই। এখন আমি ওখানকার কেউ না।
কর্মকর্তাদের টাকায় বিমান বিলাস করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তোমার সাথে কথা বলা আমার উচিত হয় নাই।
দেশে না থাকায় সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মঈনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভিসি ও কোষাধ্যক্ষের বিমান বিলাস সম্পর্কে কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মোহাম্মদ ছাদেক হোসেন মজুমদার কালবেলাকে বলেন, আমি এ বিষয়ে জানি না। আমরা পিকনিক কমিটি করে দিয়েছিলাম, তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে। টাকা ম্যানেজ করা, ভিসি ও কোষাধ্যক্ষের বিমানের টিকেট, তাদের যাবতীয় বিষয় ডিল করতেন সভাপতি জাকির হোসেন।
সভাপতি জাকির হোসেন কারাগারে থাকার কারণে তার উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে আমতা আমতা করে বলেন, এই রকম কিছুই না। তিনি আসলে তার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার মামলায় সভাপতি জাকির হোসেন কারাগার রয়েছেন। ফলে তার বক্তব্য নেওয়ার সুযোগ হয়নি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলাইমান কালবেলাকে বলেন, তারা যদি প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ করে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন