সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের এক সাধারণ সভায় দুই বছরের জন্য কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক ও দুইজন যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, যুগ্ম আহ্বায়ক (দক্ষিণ) হিসেবে অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম এবং অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার (উত্তর) আসেন। সাদা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউনিটের সমর্থন প্রাপ্ত হিসেবে এই কমিটি মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। কলা অনুষদের শিক্ষক লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিদায়ী যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান সভাপতিত্ব করেন।
অপরদিকে, গত সোমবার রাতে সাদা দলের এই নির্বাচিত কমিটি প্রত্যাখ্যান করে দলকে পুনর্গঠনের নামে আরেকটি কমিটি ঘোষণা করেছে এক পক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব মিটিং রুমে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কমিটির ঘোষণা দেওয়া হয়। কমিটিতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম তালুকদারকে আহ্বায়ক এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ আলমুজাদ্দেদী আলফেছানী এবং তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ উল ইসলামকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।
এই পক্ষের দাবি, পুর্নগঠিত সাদা দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একটি স্বতন্ত্র প্যাটফর্ম। কেবলমাত্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার ধারক-বাহক সদস্যরাই এতে যুক্ত থাকবেন। দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও আপসকামিতার বিরুদ্ধে এটি এক কার্যকর প্রতিবাদ।
তবে জানা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিদ্রোহী শিক্ষকরা এই কমিটি করায় বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এ বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ড কর্তৃক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। বিদ্রোহী কমিটির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
বিএনপি, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামে নতুন কোনো সংগঠন করা যাবে না বলে দলের নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত ২৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে যারা সংগঠন করবে তার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা দলের কেউ নন। যদি এসব সংগঠনের সঙ্গে দলের কেউ জড়িত থাকেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জাতীয়তাবাদী নামে কোনো সংগঠন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপির কেউ যদি ভুঁইফোঁড় সংগঠনের ব্যানারে যায়, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দল সমর্থিত কয়েকজন শিক্ষক জানান, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে বিএনপিপন্থি শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বেশি নিয়োগ হয়নি। ফলে প্রায় দেড় দশকে যেসব শিক্ষক রাজপথে সোচ্চার ছিলেন তাদের অন্যতম হচ্ছে ড. মোর্শেদ হাসান খানের নেতৃত্বে নতুন কমিটি। তাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। আরও কিছু শিক্ষক রাজপথের কর্মসূচিতে ছিলেন। তবে কমিটি গঠন নিয়ে নিজেদের মধ্যে যেভাবে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছে তা খুবই দুঃখজনক এবং অপ্রত্যাশিত। আমরা আশা করি এর নিরসন হবে।
এর আগে, গত সোমবার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে সাদা দলের মূল অংশের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- এর আগে সাদা দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি ইউনিট থেকে একজন আহ্বায়ক ও দুইজন যুগ্ম আহ্বায়কের নাম প্রস্তাব করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ইউনিট কমিটিগুলোকে লিখিতভাবে বলা হয়। ইউনিট কমিটিগুলো নির্ধারিত ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে স্ব স্ব ইউনিটের সাধারণ সভা করে একজন আহ্বায়ক ও দুইজন যুগ্ম আহ্বায়কের নাম প্রস্তাব করে। ইউনিটগুলো থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবসমূহ সাদা দল কেন্দ্রীয় কমিটির গত ২২ ডিসেম্বরের সভায় উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা যায় ১২টি ইউনিটের মধ্যে ৮টি ইউনিট থেকে মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের নাম আহ্বায়ক হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম তালুকদারের নাম ৪টি ইউনিট থেকে প্রস্তাব করা হয়। যুগ্ম আহ্বায়ক (দক্ষিণ) হিসেবে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালামের নাম ৭টি ইউনিট থেকে, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল মুজাদ্দেদী আলফেছানী-এর নাম ৪টি ইউনিট থেকে এবং ফলিত রসায়ন ও কেমি-কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম মুস্তাফিজুর রহমানের নাম ১টি ইউনিট থেকে প্রস্তাব করা হয়। যুগ্ম আহবায়ক (উত্তর) হিসাবে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার-এর নাম ৭টি ইউনিট থেকে, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মেজবাহ্ উল ইসলাম-এর নাম ৪টি ইউনিট থেকে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহা. রুহুল আমীন-এর নাম ১টি ইউনিট থেকে প্রস্তাব করা হয়। একই দিনে, বিদ্রোহী শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব ভবনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আলাদা অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করেন।
নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে বিদ্রোহী পক্ষের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মেজবাহ্ উল ইসলাম বলেন, আমরা সাদা দলকে পুনর্গঠন করেছি। যেই সাদা দল একটি বলয়কে কেন্দ্র করে বিগত ১৫-২০ বছর যাবৎ চলছে, আমরা সেই সাদা দলকে অযোগ্য, সুবিধাবাদী ও জামাতমুক্ত এবং দুর্নীতিমুক্ত সাদা দল হিসেবে গড়ে তুলে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা দলের কল্যাণে কাজ করছি। এ ব্যাপারে আমিনুল ইসলাম তালুকদার মুঠোফোনে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সদ্য সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, সাদা দলের অভ্যন্তরে এমন বিভাজন অনাকাঙ্ক্ষিত। জাতির এই ক্রান্তিকালে যখন আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত, সেই মুহূর্তে একটা ছোট্ট অংশ দলের বাইরে গিয়ে একই নাম দিয়ে কমিটি ঘোষণার মতো ঘটনা খুবই দুঃখজনক। আমাদের সংগঠনটি গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবেই পরিচালিত হয়। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের সমর্থন নিয়ে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে ছোট্ট একটা অংশ, নিজেরাই নিজেদেরকে কমিটিতে নেতা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের কমিটির পাশাপাশি ৫ জন উপদেষ্টার নামও ঘোষণা করেছে, যেখানকার তিনজনই জানিয়েছেন তাদের কনসার্ন নেওয়া হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের বিভাজন সম্পর্কে বক্তব্য জানতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। পরে বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি আপাতত কোনো কমেন্ট করব না।’
মন্তব্য করুন