দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও একটি বছর। দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর। নতুন বছরকে ঘিরে নানা জল্পনা কল্পনা সবার মাঝে। অনেকেই নতুন বছরের পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত। সুখ দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা নিয়ে সবাই যখন ২০২৪ সালকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত তখন একটু পেছন ফিরে দেখা যাক ফেলে আসা দিন ও হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে।
২০২৪ সালে মোট ৬ জন শিক্ষার্থীকে হারিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একজন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দুজন, ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যায় দুজন, ফেনিতে ত্রাণ বিতরণে একজন এবং অক্সিজেনের অভাবে আরও এক শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন।
ঈদ উপহার নিয়ে যাওয়ার পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু : আত্মীয়ের বাসায় ঈদ উপহার নিয়ে যাওয়ার পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আল আমিন।
গত ২৬ মার্চ বিকেল চারটার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আল-আমিনের বাড়ি মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার কর্ণপাড়া গ্রামে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের পরিবারে একমাত্র আল আমিনেরই সুযোগ হয়েছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক পরীক্ষা শেষ করে ছুটি কাটাতে বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি।
বড় ভাই নয়ন তালুকদারের নতুন বাইকে কিছুদিন আগেই বাইক চালানো শিখেছিলেন আল আমিন। সেই মোটরসাইকেল করে এক আত্মীয়ের বাসায় ঈদ উপহার নিয়ে যাওয়ার পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে আহত হন তিনি।
দুদিন পর ২৯ মার্চ ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
মাইগ্রেনের ব্যথায় অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে পোস্টের পরদিনই আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মান্না দে।
২২ মে গোপালগঞ্জ সদর থানার চন্দ্র দিঘলিয়ার ভাড়া বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পড়ালেখা শেষ করে গোপালগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেকট্রনিকস টেকনোলজির ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
মৃত্যুর আগে ২১ মে রাতে মান্না দে মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেন, ‘প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কের নিউরনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত। মাইগ্রেন এক অভিশাপের নাম। মাইগ্রেনের কাছে হেরে গেলাম। জীবনযুদ্ধে আমি পরাজিত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ ২ শিক্ষার্থী : চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম ও মাগুরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থী।
১৮ জুলাই বহদ্দারহাট এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন চবির ইতিহাস বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই মারা যান হৃদয় চন্দ্র তরুয়া।
অন্যদিকে আওয়ামী সরকার পতনের ১ দিন আগে ৪ আগস্ট নিজ জেলা মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালী এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফরহাদ হোসেন। চবির ইতিহাস বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন ফরহাদ হোসেন।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বড় ভাই গোলাম কিবরিয়াকে ফরহাদ বলেছিলেন, ‘ভাই, চলেন শহীদ হয়ে আসি।’
ত্রাণ দিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চবি শিক্ষার্থী : ফেনি, নোয়াখালীতে বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ৮ দিন পর মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফাহিম আহমাদ পলাশ।
৪ সেপ্টেম্বর ভোর ৬টা ২০ মিনিটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ঢাকায় মারা যান পলাশ।
এর আগে ২৭ আগস্ট পলাশের ত্রাণবাহী গাড়ি মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ এলাকায় পৌঁছালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পলাশকে। ৮ দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিউ) থাকার পর অবস্থার অবনতি দেখে ৩ আগস্ট সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হলে ১দিন পর দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
চবি শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে চিকিৎসকের গাফিলতির অভিযোগ : হাসপাতালে নেওয়ার পথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পরিসংখ্যান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম নির্মা মারা যান। ২৫ অক্টোবর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকার একটি বাসার দুই তলায় থাকতেন ওই ছাত্রী। শুক্রবার দুপুর দেড়টার দিকে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে বাসার অন্য দুজনের সহযোগিতায় নাঈমাকে চবি মেডিকেলে নেওয়া হয়।
পরে দুপুর ২টার দিকে অক্সিজেন দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক সান্তনু মজুমদার। তবে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেট এলাকায় গেলে সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। পরে হাটহাজারী থেকে একটি সিলিন্ডার কিনে পুনরায় চমেক হাসপাতালের উদ্দেশে যান তারা। সেখানে পৌঁছলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নাঈমাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনার পরে শুক্রবার সন্ধ্যায় চিকিৎসকের গাফিলতির অভিযোগ তোলে চবি মেডিকেলে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
মানুষ হিসেবে আমি ব্যর্থ লিখে চবি শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা : ‘মানুষ হিসেবে আমি ব্যর্থ’ লিখে আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী তাজরিয়ান আহমেদ সোয়ারা।
১ নভেম্বর ভোর ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে একটি ফ্ল্যাট বাসায় এ ঘটনা ঘটে।
আত্মহত্যার আগে একটি চিরকুটে তাজরিয়ান লিখেন- ‘I am sorry, i failed as a human.’
মন্তব্য করুন