ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসির রাজু ভাস্কর্য সংলগ্ন মেট্রোরেলের পিলারে পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রক্ত ও কালি মাখানো ঘৃণাসূচক গ্রাফিতির (ঘৃণাস্তম্ভ) একাংশ মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মুছে ফেলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলকালাম সৃষ্টি হয়েছে।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে তারা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করে তারা বিভিন্ন মন্তব্য করছেন।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের পক্ষ থেকে নিজেদের ভুল ও ব্যর্থতা স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্তম্ভটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘৃণাস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দিবে বলে জানিয়েছে।
তবুও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এই স্মারক মুছে ফেলার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে টিএসসিতে রোববার সন্ধ্যায় বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেন শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, জুলাই-আগস্ট বিপ্লব চলাকালে টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের পেছনের মেট্রোরেলের পিলারে অঙ্কিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার গ্রাফিতিতে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা রং, কালি, কাদা ও জুতা নিক্ষেপ করে (যদিও ৩ আগস্ট থেকেই এই কর্মসূচি শুরু হয়)। পাশাপাশি ছবিতেই জুতার মালা পরিয়ে দেয় এবং ছবি আঁকা এই পিলারের নাম দেয় ‘ঘৃণা স্তম্ভ’। যার ফলে ছবিটি হয়ে যায় প্রতিবাদের একটি প্রতীক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এর মাঝে, গত শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) গভীর রাতে গ্রাফিতিটি ক্রেন নিয়ে মুছতে আসে সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মী। এটি মুছে ফেলা অবস্থায় কিছু শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই এ কাজ করা হয়েছে এমন তথ্য জানতে পেরে তারা রাত ২টার পর বিক্ষোভ শুরু করলে সেই মোছার কাজ বন্ধ হয়।
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলামসহ আরও কয়েকজন ঘটনাস্থলে এসে কেন এটা মুছে ফেলা হচ্ছে এমন প্রশ্ন তোলেন। এর পেছনে কারা জড়িত, কার অনুমতিতে এমনটা করা হচ্ছে, তা তারা জানতে চান।
তখন মেট্রোরেলের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে থাকা এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইউসুফ আহমেদ বলেন, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে শিক্ষার্থীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন ও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়ার আশ্বাস দেন। পাশাপাশি, এ স্তম্ভকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা করার কথা জানান। পরবর্তীতে রাতেই শেখ হাসিনার মুছে যাওয়া গ্রাফিতির অংশে (মুখ) বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাবির চারুকলা অনুষদ শাখার সদস্য মৃধা রাইয়ান, ঋষি, রাইয়ান ফেরদৌস ও সর্দার নাদিম মাহমুদ শুভ আরেকটি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকেন।
ঘটনার বর্ণনায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে এনএসআই (রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা) থেকে ফোন দিয়ে তাকে অবগত করা হয়েছে যে, দৃষ্টিকটু লাগায় সিটি করপোরেশন এটা মুছে অন্য কিছু করবে। এজন্য শনিবার রাত আনুমানিক ২টার দিকে ঘৃণাস্তম্ভ মুছে দেওয়ার চেষ্টা করলে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের আটকায়। কিন্তু ততক্ষণে শেখ হাসিনার মুখের অংশ মুছে ফেলা হয়ে যায়। পরবর্তীতে উপস্থিত সবার মতামতের ভিত্তিতে পরের ছবিটা নির্বাচিত করে আঁকা হয়।
আব্দুল ওয়াহেদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, পরে আঁকা ছবি স্পষ্ট বিকৃতি, যা হাসিনাকে রিপ্রেজেন্ট করে না। আগের ছবি আঁকতে হবে। ছবিটি রাতের আঁধারে মোছা হয়েছে, ক্রেডিটের জন্য আবার রাতেই আঁকা হয়েছে। ক্রেডিটের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী যেটা চাইবে ঢাবির সিদ্ধান্ত তাই হতে হবে। এখানে আগের গ্রাফিতিই আঁকা হবে, জুতার মালাও থাকবে, ছবিতে জুতা মারাও হবে সম্মিলিতভাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ বলেন, শেখ হাসিনার ঘৃণাসূচক গ্রাফিতি মোছার উদ্যোগ কারা নিয়েছে তা সিরিয়াসলি জানতে চাই। রাজু ভাস্কর্যের পাশে মেট্রোরেলের এই পিলারে হাসিনার ছবির ওপর রক্তের মতো রং ছড়িয়ে ডাইনিরূপে উপস্থাপন আর কালি মেখে এবং জুতার মালা পরিয়ে রাখা হয়েছিল।
পাশাপাশি তিনি বলেন, এগুলো মুছে নরমাল কালার করার মানে এস্থেথিজম চর্চা নয়, বরং গণঅভ্যুত্থানের সিম্বলিক ব্যাপারগুলোকে মানুষের চোখের সামনে থেকে ভুলিয়ে দেওয়া। এই সিম্বলগুলো গণঅভ্যুত্থানের পরিচায়ক। এই ছবিগুলো মানুষের কাছে একটা গভীর বার্তা তুলে ধরত। কিন্তু কার উদ্যোগে এই পিলারের সিম্বলগুলো মোছা শুরু হয়েছে এই গভীর রাতে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করা দরকার।
মুছে ফেলার পরে আঁকা গ্রাফিতির বিষয়ে তিনি বলেন, ভিন্নটা কেন করা হবে? আগেরটাই লাগবে, হুবহু আগেরটাই এবং ওইটার ওপরও কালি মেখে, রক্তের মতো লাল রং দিয়ে ডাইনি টাইপ ভাব রাখতে হবে। আগেরটায় যেভাবে জুতার মালা দেওয়া ছিল, ওই একইভাবে রাখতে হবে। মানে হুবহু রেস্টোর করতে হবে। ওইটার ভেতর যে মেসেজ ছিল, নতুনটার ভেতর সেটা নাই। গণঅভ্যুত্থানে দেশের জনগণ হাসিনাকে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করে উৎখাত করেছিল, সেটার অটো রিপ্রেজেনটেশন ছিল ওইটাতে৷ হুটহাট করে যারা এইটা মোছার প্ল্যান করেছিল বা যাদের মাথা দিয়ে এই প্ল্যান বের হয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে আইডেন্টিফাই করে কঠোর জবাবদিহিতার ভেতর নিয়ে আসা উচিত।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদী বলেন, ইনকিলাব মঞ্চ থেকে একটা উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। হাসিনার আগের ছবিটার একটা বড় রেপ্লিকা বানাবো। সেটা দিয়ে ম্যুরাল বানিয়ে টিএসসিতে স্থাপন করব। হজে গিয়ে মানুষ যেমন শয়তানকে পাথর মারে, আপনারাও গিয়ে রোজ এই শয়তানরে পাথর বা স্যান্ডেল মারবেন।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এবি জুবাইর বলেন, আগের ছবি আবার এঁকে আবার জুতা নিক্ষেপ করা দরকার, আবার জুতার মালা ঝুলিয়ে দেওয়া দরকার। তবে সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে কারা এইটা মুছে ফেলেছে, কাদের ইন্ধনে মোছা হয়েছে। আমাদের কাছে লতাপাতা আঁকা দেয়ালের চেয়ে জুতার মালা পরিহিত হাসিনার ছবি আঁকা দেয়ালই সুন্দর।
এদিকে, গ্রাফিতি মুছে ফেলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
রোববার (২৯ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদের দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমরা অতি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ২৯ ডিসেম্বর গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পেছনে মেট্রোরেলের দুটি পিলারে থাকা শেখ মুজিব এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘৃণাসূচক গ্রাফিতি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। জুলাই আন্দোলনে এই দুটি গ্রাফিতি বিপ্লব, প্রতিরোধ এবং ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের প্রতিনিধিত্ব করে। এই স্মৃতিকে তাজা রাখা এবং প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি প্রক্টরিয়াল টিমের অনিচ্ছাকৃত ভুল। এ জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে আমরা আরও সতর্ক থাকার অঙ্গীকার করছি।
এতে আরও বলা হয়, প্রক্টরিয়াল টিমের উপস্থিতিতে গত রাতেই শিক্ষার্থীরা মুছে ফেলা গ্রাফিতি অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে এঁকেছেন। এই স্তম্ভটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘৃণাস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দিবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার এই ঘৃণাকে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রহণ করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফদ্দীন আহমদ কালবেলাকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশনা এসেছিল যে, শেখ হাসিনার ছবি এরকম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকতে পারে না, সরাতে হবে। এই নির্দেশনা আসলে ভিন্ন উদ্দেশ্যে বা জুলাই বিপ্লবের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়নি। কিন্তু, এ সিদ্ধান্তকে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেয়নি। যার কারণে, আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগে যেরকম ছবি ছিল, সেরকম ছবিই ফের আঁকানো হবে। এ নিয়ে আমাদের চারুকলা অনুষদের ডিন মহোদয় কাজ করছেন। আজ রাতেই এ কাজ সম্পন্ন করা হবে।
মন্তব্য করুন