‘আপনার তো ছুটি হবে না, যদি ছুটি হয়েও যায় এক বছর পরে এসে আর যোগদান করতে পারবেন না। তখন ফাইলের পিছনে তদবির করতে করতে জুতার তলা খুলে যাবে, তবুও ফাইল নড়বে না। এমনকি, তখন চাইলে চাকরি ছাড়তেও পারবেন না। আপনি তো দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা জানেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বুঝেন। তাই, এখনি চাকরি ছেড়ে চলে যান।’
২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) সিনিয়র লেকচারার হিসেবে চাকরির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মহব্বত আলী রেজিস্ট্রারের কাছে এক বছরের জন্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি (অসাধারণ) ছুটির আবেদন করেন। এরপর বিভাগের সিএন্ডডি কমিটির সুপারিশ বিভাগীয় চেয়ারম্যানের অনুমোদনের পর আবেদনপত্র নিয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের তৎকালীন ডিন ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে আবেদনপত্রে সুপারিশ না করে উল্টো তিনি এ কথা বলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরপর ওই অধ্যাপককে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়।
অধ্যাপক ড. মো. মহব্বত আলীর দাবি, বিভাগের পক্ষ থেকে ছুটির সুপারিশ এবং অর্জিত ও অসাধারণ ছুটি পাওনা থাকা সত্ত্বেও ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শী (বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের অনুসারী) এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুসারীদের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় প্রচ্ছন্ন হুমকির মাধ্যমে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম তাকে অবসর নিতে বাধ্য করেছেন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য বরাবর এক আবেদনে ড. মো. মহব্বত আলী এ সব তথ্য জানিয়েছেন। আবেদনে তিনি চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিও জানান।
আবেদনপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রচলিত বিধি অনুসারে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে অস্ট্রেলিয়ার এমআইটিতে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে চাকরি করার জন্য অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর এক বছরের জন্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি (অসাধারণ) ছুটির আবেদন করি। প্রয়োজনীয় ছুটি পাওনা থাকায় ২৪ ডিসেম্বর অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সিএন্ডডি (কো-অর্ডিনেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) কমিটির সভায় আমার ছুটি মঞ্জুরের জন্য সুপারিশ করে ডিন অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রারের নিকট প্রেরণের জন্য বিভাগীয় চেয়ারম্যান অনুমোদন করেন।
ড. মো. মহব্বত আলী বলেন, আবেদন যাতে ডিন অফিস হয়ে রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটতম পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় (২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯) নথিভুক্ত হতে পারে সে জন্য আমি হাতে ছুটির আবেদনপত্রটি নিয়ে ডিনের (অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম) সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই এবং বিস্তারিত বর্ণনা করি। সব কিছু শুনে তিনি আমাকে ছুটির পরিবর্তে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আদেশ করেন। তিনি বলেন, আপনার তো ছুটি হবে না, যদি ছুটি হয়েও যায় এক বছর পরে এসে আর যোগদান করতে পারবেন না। তখন ফাইলের পিছনে তদবির করতে করতে জুতার তলা খুলে যাবে, তবুও ফাইল নড়বে না। এমনকি, তখন চাইলে চাকরি ছাড়তেও পারবেন না। আপনি তো দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা জানেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বুঝেন। তাই, এখনি চাকরি ছেড়ে চলে যান। আর যদি অবসরে যাওয়ার আবেদন করেন তাহলে যাতে রিটায়ারমেন্টের (অবসর) টাকা দ্রুত পেতে পারেন সে ব্যবস্থা করে দিব। এসব কথা শুনে আমি বিস্মিত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। ২৪ বছর সুনামের সঙ্গে চাকরি করা একজন অধ্যাপককে আরেকজন অধ্যাপক কিভাবে এরকম অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য কথা বলতে পারে সেটা আমার বোধগম্য নয়। এটা একরকম হুমকি ও জীবনের ভয় দেখানো ছাড়া কিছু না। তবুও আমি তাকে আমার দরখাস্ত ফরোয়ার্ড করার জন্য অনুরোধ করে চলে আসি।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষক আরও বলেন, ২০১৮ সালে আমি বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন নির্বাচনের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের বিপরীতে সাদা দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম- যেটা তিনি ভালো চোখে দেখেননি। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এত প্রভাবশালী শিক্ষক ছিলেন যে, তার বিরোধিতা করা কাউকে সে সহ্য করতে পারত না। আমি তার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় সে অপমানিত বোধ করেছেন। তা ছাড়া অনুষদের আওতাধীন ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চ (বিবিআর)-এর পরিচালক নির্বাচনে আমি তার মনোনীত প্রার্থীদের দুইবার পরাজিত (২০১৭ ও ২০১৯) করাতেও আমার প্রতি তিনি বিরক্ত ছিলেন। এমনকি এর আগেও বিবিআরের আওতাধীন রিসার্চ মেথোডোলজি কোর্সে ডিবিএর এক ছাত্রীর (প্রভাবশালী ব্যাকারের স্ত্রী) পরীক্ষা না দিতে চাওয়ার মৌখিক অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার কারণেও তিনি আমার উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম অনেক নামকরা পুলিশ কর্মকর্তা/ব্যবসায়ী ছাত্রের সুপারভাইজার ছিলেন। র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ তার মধ্যে অন্যতম। বেনজীর আহমেদ প্রায়ই তার অফিসে এসে আড্ডা দিত। এটাকে সে এক ধরনের শক্তি হিসেবে প্রদর্শন করত। অন্যরাও তার দাপট সম্পর্কে ভয় পেত। এসব চিন্তা মাথায় রেখে ভাবলাম, যদি আমার ছুটির আবেদন নাকচ হয়ে যায় অথবা ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ সিন্ডিকেটের আলোচ্যসূচিতে না থাকে তাহলে আমি একদিকে অস্ট্রেলিয়ার একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব, অন্যদিকে জীবনের হুমকি নিয়ে চলতে হবে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরের মহলের কাছে গেলে আরও হিতেবিপরীত হতে পারে আশঙ্কায় কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়ে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের বর্তমান ডিন ড. মাহমুদ ওসমান ইমামকে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।
তবে এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, আমাদের কাছে এরকম বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। এগুলো আইনগত জায়গা থেকে আমরা দেখছি এবং আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করছি। তাই, আইন উপদেষ্টার মতামত অনুযায়ী কোনো শিক্ষক যদি রাজনৈতিক কারণে কিংবা অর্থনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার হন তাহলে তিনি যেই মতাদর্শের হোক আমরা ব্যবস্থা নেব।
প্রসঙ্গত, অসাধারণ ছুটি নেওয়ার বিধান হলো- কোনো শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যেতে চাইলে কিংবা অসাধারণ ছুটির দরকার হলে তাকে বিভাগের চেয়ারম্যানকে মাধ্যম করে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করতে হয়। সেখান থেকে অনুমোদন হওয়ার পর তা বিভাগে সিএন্ডডি কমিটির সভায় যায়। পরে সিএন্ডডি সুপারিশ করলে সেটা অনুষদ ডিনকে অবগত করে সিন্ডিকেটে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং সেখান থেকেই ছুটি দেওয়া হবে কি হবে না তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন