যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএফএসএ)-এর বিশ্বজুড়ে পরিচালিত নিরাপদ ফেরির নকশা এবং পরিচালনার লক্ষ্যে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় ইন্দোনেশিয়ার সেপুলুহ নোপেম্বের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইটিএস)।
জানা যায়, এবারের ১১তম আসরে বুয়েটের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবায়ের ইবনে আওয়ালের তত্ত্বাবধানে ৭ সদস্যের ‘টিম ব্লাক পার্ল’ অংশগ্রহণ করে। এই টিমের সদস্যরা হলেন- মো. আব্দুল কাদের (টিম ক্যাপ্টেন), ইমন ঘোষ প্রান্ত, সাইয়েদ সাদিক সিদ্দিকী, মিনহাজুল ইসলাম, মো. সাফায়েত হোসেন শিশির, আবু রাসেল ও সামিউন মুনতাসির সিয়াম। গত ৫ আগস্ট অনলাইনে অনুষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিযোগিতার ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। পুরস্কার প্রদান করা হবে আগামী ২৮ থেকে ২৯ অক্টোবর।
অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতিবারের মতো এবারও নির্দিষ্ট রুটের জন্য নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব নৌযানের নকশা তৈরির প্রতিযোগিতা হয়। এ বছর অংশগ্রহণকারীদের চ্যালেঞ্জ ছিল নাইজেরিয়ার নাইজার নদীতে Ndoni-Idah (১৯০ কিমি) ঘাটের মধ্যে চলাচল উপযোগী একটি RoPax (রোপ্যাক্স) ফেরির ডিজাইন করা, যা ১৫০-২০০ প্যাসেঞ্জার, ১৫-২০টি চার চাকার গাড়ি ও একইসঙ্গে কৃষিপণ্য পরিবহন করতে সক্ষম। নদীর ভূতাত্ত্বিক অবস্থা যেমন- সরু চ্যানেল, সীমিত নাব্য, বিপদজনক ছোট পাথর, ভাসমান কাঠ ও কচুরিপানার উপস্থিতির পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন শর্ত যেমন, কোনো এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম ব্যবহার করা যাবে না, প্রপালশন সিস্টেমটি পরিবেশবান্ধব হতে হবে ইত্যাদি ডিজাইন প্রক্রিয়াটাকে আরও চ্যালেন্জিং করে তুলেছিলো।
‘টিম ব্লাক পার্ল’ এই চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে। টিম ক্যাপ্টেন মো. আব্দুল কাদের বলেন, আমরা সমস্যা চিহ্নিত করে উদ্ভাবনী ও কার্যকরী সমাধান খোঁজেছি। উদাহরণস্বরূপ- কচুরিপনা, ভাসমান কাঠ ও পাথর থেকে ফেরিকে রক্ষা করতে আধুনিক টিলটেবল প্রপেলারে অতিরিক্ত প্রটেকশনের ব্যবস্থা করেছি এবং জাহাজের কাঠামো শক্তিশালী করেছি। ফেরিটিকে পরিবেশবান্ধব করতে ইলেকট্রিক প্রপালশন সিস্টেমের সঙ্গে হাইড্রকাইনেটিক টার্বাইন যুক্ত করেছি, যা পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। সাধারণ সোলার প্যানেলের পরিবর্তে পেরোভস্কাইট সোলার সেল ব্যবহার করেছি, যা বেশি কার্যকর।
এ ছাড়া প্রচলিত এয়ার কন্ডিশনিংয়ের বদলে আমরা ডিজাইন করেছি ‘ন্যাচার ইন্সপায়ার্ড ভেন্টিলেশন সিস্টেম’ যা জ্বালানী সাশ্রয় করে কার্যকরী সমাধান দিতে সক্ষম। আমার বিশ্বাস, আমাদের এই উদ্ভাবনী চিন্তাধারা আমাদের অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে রেখেছে।
প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয় ইউনিভার্সিটাস ইন্দোনেশিয়া। বিজয়ী দলগুলো যথাক্রমে ৫,০০০, ৩,০০০ ও ১,০০০ ডলার পুরস্কার পাওয়ার কথা রয়েছে। গত ৯ম এবং ১০ম আসরেও বুয়েটের দল যথাক্রমে তৃতীয় স্থান ও অনারেবল মেনশন অর্জন করে, যা প্রতিষ্ঠানটির ধারাবাহিক সাফল্যেরই প্রমাণ।
এ বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে টিমের ফ্যাকালটি অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. জোবায়ের ইবনে আওয়াল বলেন, বুয়েটের ছাত্ররা প্রযুক্তিগত এই দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারা বিকাশ ঘটিয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাধ্যমে একটি কঠিন প্রতিযোগিতায় সাফল্য নিয়ে এসেছে। তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। এই সাফল্য এটা প্রতীয়মান করে যে, বুয়েটের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগ উদ্ভাবনী, প্রতিভাবান এবং দক্ষতাসম্পন্ন তরুণ প্রকৌশলী তৈরি করছে। যারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক জাহাজ শিল্পে অভাবনীয় বিকাশ ঘটানোর সক্ষমতা রাখে এবং একই সঙ্গে ব্লু ইকোনমি, মহাসাগর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএফএসএ) বিশ্বজুড়ে পরিচালিত নিরাপদ ফেরির নকশা এবং পরিচালনা নিয়ে কাজ করে। ফেরি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং নিরাপদ ফেরির প্রাপ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই সংস্থা প্রতিবছর একটি আন্তর্জাতিক ফেরি ডিজাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।
মন্তব্য করুন