একাধিকবার নারী ও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকা এবং তদন্ত চলা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সফিউল্লাহ প্রশাসনিক ভবনের গুরুত্বপূর্ণ পদে যেতে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপিপন্থী কয়েকজন শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকদের কার্যালয়ে তার আনাগোনা এবং তদবির প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মো. সফিউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কার্যালয় অথবা প্রশাসনিক ভবনের যেকোনো এক শাখা প্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য তদবিরে ব্যস্ত আছেন। তিনি কিছুদিন ধরে প্রতিনিয়তই ভিসি-প্রোভিসি কার্যালয় ও বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিশেষ করে বিএনপিপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের দপ্তরে দৌঁড়ঝাপ করে আসছেন। তিনি নিজেকে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি আদর্শের লোক বলে প্রচার করছেন।
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, আইআর ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে মো. সফিউল্লাহ প্রিন্সিপ্যাল শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ভর্তি ও নথিপত্র দপ্তর (এসএসএআর)-এ টেকনিক্যাল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক অফিসার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৬ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে প্রিন্সিপ্যাল টেকনিক্যাল অফিসার হন। একই বছরে আর্থিক ও নারী কেলেঙ্কারির কারণে সিন্ডিকেট কর্তৃক সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সিন্ডিকেট কর্তৃক সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ছিলেন।
২০১৭ সালের শেষের দিকে সিন্ডিকেট সভায় ‘মাসিক বেতন ও বেতন স্কেলের কোনো পরিবর্তন না করে, শাস্তি হিসেবে শুধু পদাবনমন করা হয়’। অর্থাৎ ‘প্রিন্সিপ্যাল টেকনিক্যাল অফিসার’ হতে এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার করা হয়। পরে রেজিস্ট্রারের ব্যক্তিগত শাখায় বদলি করা হয়।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পদসহ তাকে মনোবিজ্ঞান বিভাগে বদলি করা হয়। মনোবিজ্ঞান বিভাগেও সফিউল্লাহ আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত মনোবিজ্ঞান বিভাগের সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটির পঞ্চম সভায় মো. সফিউল্লাহর অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়-ব্যায়ের হিসাব তদন্ত করার জন্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে সদস্য করা হয় অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. রেজাউল করিম এবং অধ্যাপক ড. আয়েশা সুলতানাকে। যদিও সেই তদন্ত আজও আলোর মুখ দেখেনি।
সম্প্রতি মনোবিজ্ঞান বিভাগের সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটির সদস্যরা সফিউল্লাহর আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে যে তদন্ত প্রক্রিয়াধীন আছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানকে অবহিত করে একটি চিঠিও দিয়েছেন।
গত ০৩ সেপ্টেম্বর দেওয়া এই চিঠিতে বলা হয়, মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সফিউল্লাহ (যিনি তার পূর্বের কর্মস্থলে আর্থিক অনিয়মের দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়ে পদাবনতিপ্রাপ্ত)-এর বিরুদ্ধে মনোবিজ্ঞান বিভাগে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় সি এন্ড ডি কমিটির সভায় অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানমকে আহ্বায়ক করে এবং অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. রেজাউল করিম ও অধ্যাপক ড. আয়েশা সুলতানাকে সদস্য করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যানের (সদ্য সাবেক) অসহযোগিতা ও বিরোধিতার কারণে সেই কমিটির কার্যক্রম আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে নাই। এমতাবস্থায়, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে একজন সৎ, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অন্যায় ও দুর্নীতি প্রশ্রয় পাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, আমাদের বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সফিউল্লাহর বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া তদন্তটি সম্পন্ন হয়নি। বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই তদন্তটা আটকে দিয়েছে। তিনি মূলত চেয়েছিলেন এই কমিটিতে থাকতে। তখন তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যান থাকার কারণে শিক্ষকরা তাকে না থাকার পরামর্শ দিলে তিনি ক্ষুব্ধ হন। সেই ক্ষোভের জায়গা থেকেই তিনি বলেছিলেন যে, আমাকে ছাড়া দেখবো কীভাবে এই তদন্ত আগায়। এরপর আর এটা আগায়নি।
আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে মো. সফিউল্লাহ কালবেলাকে বলেন, হিসাব-নিকাশের ওই অভিযোগের ভিত্তিতে কমিটি গঠিত হওয়ার পর তিন বছর একটানা এক চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ের মধ্যে সেই তদন্ত কমিটি কোনো মিটিংও করেনি, কাজও করেনি। আমি আমার হিসাব দেওয়ার জন্য তিন বছর রেডি ছিলাম। তৎকালীন চেয়ারম্যান তাদেরকে বারবার মিটিংয়ে বসার আহ্বান জানালেও তারা ভ্রূক্ষেপ করেননি। এখনো নতুন কোনো কমিটি গঠন করে আমাকে ডাকা হলে, হিসাব দিতে প্রস্তুত আছি।
গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার তদবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কোনো রকম তদবির করিনি এবং কারো কাছে যাইনি। আমি এর আগে রেজিস্টার বিল্ডিংয়েই কর্মরত ছিলাম। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করি বলেই আমাকে তারা ট্রান্সফার করে মনোবিজ্ঞান বিভাগে পাঠিয়েছিল। তদবির করছি বিষয়টা এমন নয়। যদি সুযোগ পাই তাহলে আমি কাজ করবো, নাহলে আমি আমার বিভাগেই থাকবো।
তদন্ত আটকে দেওয়ার অভিযোগের জবাবে বিভাগের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, যাদেরকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারাই তদন্ত করবে। এখানে আমি বাধা দিব কেন?
বিভাগে সফিউল্লাহর আর্থিক অনিয়মের তদন্ত প্রসঙ্গে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করলো। আমি আমার জায়গা থেকে বিধি অনুযায়ী তদন্তের বিষয়টা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। আর এই কমিটিতে আমি সদস্য হিসেবে ছিলাম, যেহেতু আমার ওপর বিভাগীয় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সেহেতু আমি এখানে আর থাকতে পারবো না। সেক্ষেত্রে নতুন কমিটি বা নতুন সদস্য যুক্ত করা হতে পারে।
পছন্দ মাফিক পদ পাওয়ার জন্য তদবির প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান কালবেলাকে বলেন, নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী যার যার জায়গায় থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনৈতিক তদবিরের সুযোগ নেই। আর এ বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখার জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। তারাই বিষয়টি দেখবেন এবং এ ব্যাপারে কথা বলবেন।
মন্তব্য করুন