সম্প্রতি ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর মৎস্য ঘের একাকার হয়ে গেছে। এতে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন মৎস্যচাষিরা। সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে এ সংকটের স্থায়ী সমাধানে সাত দফা দাবি জানিয়েছেন জেলাটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দর্শন বিভাগের মো. মিকাইল ইসলাম, কারুশিল্প বিভাগের তন্ময় মণ্ডল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেখ শাকিল হোসেন এবং চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের সাকিব হোসেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা জানান, ১৪ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ দিনে সাতক্ষীরায় ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে সাতক্ষীরা সদর এবং তালা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ধরনের সংকট নতুন নয়। বছরের পর বছর এমনটি হচ্ছে। এসব দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতির পাশাপাশি কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন জেলাটির বাসিন্দারা।
তাদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এ সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও অনিয়মের খেসারত দিতে হচ্ছে সাতক্ষীরাবাসীকে। কোটি কোটি টাকার নদী খনন প্রকল্প হলেও এসব প্রকল্পে অনিয়মের কারণে খননের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে না।
‘অবাস্তব’ নকশায় নদী-খাল খনন করা হয় উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, নদী খনন করে খাল এবং খাল খনন করে নালা বানানো হয়। অর্থাৎ, নদী-খালের প্রশস্ততা কমিয়ে ফেলা হয়। তলদেশ খনন না করে পাড় উঁচু করে গভীরতা দেখানো হয়। এর ফলে স্থলভাগের নিরিখে নদীর তলদেশ নিচু হয় না এবং স্থলভাগের পানি নদীতে যায় না। উপরন্তু নদীর পানি বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করে।
খননকালে নদীতে বাঁধ দিয়ে জোয়ার-ভাটার প্রবাহ রুদ্ধ করা হয় উল্লেখ করে তারা বলেন, প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা হয় না। উপরন্তু অস্বাভাবিক সময়ক্ষেপণ করা হয়। বছরের পর বছর নদীর জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ থাকায় জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়। পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ও সরকারি খালগুলো দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত মৎস্য ঘের। অবৈধভাবে খালে দেওয়া হয়েছে নেট-পাটা, যা পানি প্রবাহ বিঘ্ন করছে। ফলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত না হয়ে বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে থাকছে মাসের পর মাস।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রভাষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ইদ্রিস আলী এবং সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আলম।
ইদ্রিস আলী বলেন, সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান আশু জরুরি। উপকূলীয় এ জেলার জলাবদ্ধতার নিরসনসহ সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সাতক্ষীরা পৌরসভা নিজ নিজ জায়গা থেকে আরও তৎপর হলে সমস্যা সমাধান সম্ভব। পাশাপাশি নাগরিক ও সামাজিক সমাজের সচেতন বৃদ্ধির জন্য কাজ করা প্রয়োজন।
এ সময় দ্রুত এ সংকটের স্থায়ী সমাধানে সরকারের কাছে সাত দফা দাবি পেশ করেন শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হলো- বেতনা-মরিচ্চাপ নদীসহ অন্যান্য নদী ও খালের প্রবাহ স্বাভাবিক না করলে এবং জোয়ার-ভাটার পথ উন্মুক্ত না করলে তা কখনোই জলাবদ্ধতার সংকট দূরীকরণে কাজে আসবে না। সুতরাং, নদী-খাল খননে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। প্রকল্পগুলো কার্যকরী পদ্ধতিতে এবং সময়মতো শেষ করতে হবে। চলমান প্রকল্পগুলোয় অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করতে হবে; খাল বা জলমহালের ইজারা পুনরায় বাতিল করতে হবে। অবৈধ ভোগ-দখল ও নেট-পাটা উচ্ছেদ করতে হবে। নদী ও খালের প্রবাহ বিঘ্নিত হয় এমন উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যাবে না; নদী-খাল খননের সঙ্গে সঙ্গে সংলগ্ন বেড়িবাঁধগুলো টেকসই করতে হবে। বেড়িবাঁধে বনায়নের উদ্যোগ নিতে হবে; প্রাণসায়ের খালের দুই মুখ উন্মুক্ত করে স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সাতক্ষীরা শহরকে পুরোপুরি ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে; পৌরসভা এলাকাসহ যত্রতত্র মৎস্য ঘের নিষিদ্ধে ‘জোনিং’ করতে হবে। অন্যান্য জায়গায় আউট ড্রেন রেখে মৎস্য ঘের করতে হবে, যাতে পানি নিষ্কাশনের পথ থাকে; প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের আগেই পানি নিষ্কাশনের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হবে। অকেজো স্লুইস গেটগুলো সংস্কার করতে হবে এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিরূপণের মাধ্যমে জলবায়ু ফান্ডের অর্থ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সাতক্ষীরা জেলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন