বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) খোলা রয়েছে। বিভাগ অনুযায়ী চলছে পাঠদান ও পরীক্ষা। প্রশাসনিক কার্যক্রমও চলছে। তবে নিয়মিত উপাচার্য ও ট্রেজারার থাকতে যে গতিশীলতা থাকে সেটি থমকে গেছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্য, উপউপাচার্য ও ট্রেজারার এই শীর্ষ তিন পদই শূন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। উপউপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই শূন্য। তবে নিয়মিত একজন উপাচার্য থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় আরও বেশি গতিশীলতা বাড়বে বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া প্রক্টরিয়াল বডি, চার হলের প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষক, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক ও লাইব্রেরিয়ানসহ ১৯টি পদই রয়েছে শূন্য। যদিও জরুরি ভিত্তিতে প্রাধ্যক্ষের অবর্তমানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবাসিক শিক্ষকদের। ফলে তৈরি হয়েছে অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা ও জটিলতা। কমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি।
এদিকে নিয়মিত বা পূর্ণাঙ্গ উপাচার্য ছাড়া এই পদগুলোর নিয়োগও দিতে পারেন না বলে জানান আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মো. মুহসিন উদ্দীন। তিনি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব দেখার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। সেক্ষেত্রে পদত্যাগপত্র গ্রহণ বা নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। চিঠি অনুযায়ী আমরা ডিনদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছি। একজন পূর্ণাঙ্গ উপাচার্য এলে তিনি বিষয়টি দেখবেন। একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম আমরা চালিয়ে নিচ্ছি। যেহেতু ওই ২২টি পদ শূন্য রয়েছে সেক্ষেত্রে নিজ নিজ দপ্তরের কাজের গতিশীলতা ব্যাহত হবে, এটা স্বাভাবিক।
উন্নয়নমূলক কাজের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, অর্থবছরের কাজ গত ৩০ জুন পর্যন্ত আগের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে কাজ করেছেন সেটিতে আমাদের হাত নেই। ২০২৪-২৫ অর্থবছর আসলে উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করতে পারব।
উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. মুরশীদ আবেদীন কালবেলাকে জানান, পূর্বে অনুমোদনের কিছু কাজ চলমান রয়েছে। তবে ভোলা রোডের গেটের রাস্তার কাজটি আবহাওয়ার কারণে বন্ধ।
গত ২০ আগস্ট দুপুরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে উপাচার্য থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। এর কিছুক্ষণ আগে পদত্যাগ করেন প্রক্টর ও শেখ হাসিনা হলের প্রাধ্যক্ষ। পরে একে একে মোট ১৭ জনই পদত্যাগ করেন। পদত্যাগকারীরা হলেন— সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, সাবেক প্রক্টর ড. মো. আব্দুল কাইউম, সহকারী প্রক্টর পম্পা রানী মজুমদার, মো. ফরহাদ উদ্দীন, মো. গাজীউর রহমান, ড. মোহাম্মদ মাহফুজ আলম, শাওন মিত্র, মো. সাইফুল ইসলাম, শেরেবাংলা হলের প্রভোস্ট ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন চৌধুরী, শেরেবাংলা হলের আবাসিক শিক্ষক মোহাম্মদ সাকিবুল হাসান, শেরেবাংলা হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক আব্দুল্লাহ আহমেদ ফয়সাল, বঙ্গবন্ধু হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট ড. তারেক মাহমুদ আবীর, বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষক মো. কবির হাসান, বঙ্গমাতা হলের প্রভোস্ট ড. হেনা রানী বিশ্বাস, পরিবহন পুল ম্যানেজার মো. মিজানুর রহমান, লাইব্রেরিয়ান ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন, শারীরিক শিক্ষা অফিসের পরিচালক সৈয়দ আশিক ই ইলাহী, শেখ হাসিনা হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট ড. ইসরাত জাহান, টিএসসি পরিচালক ড. রহিমা নাসরিন, ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন। পরে, একাডেমিক ও পরীক্ষার কার্যক্রম চলমান রাখার স্বার্থে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন।
রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম জানান, বিভাগের আন্তরিকতায় একাডেমিক ও পরীক্ষা কার্যক্রম ভালোভাবেই চলছে। তবে পূর্ণাঙ্গ উপাচার্য না থাকলে সার্বিক গতিশীলতা কমে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তি না থাকার কারণে সেই দপ্তরের কাজ ব্যাহত হবে স্বাভাবিক ব্যাপার। বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ হাজার ৩০০ জন। শিক্ষক রয়েছে ২১০ জন। তার মধ্যে পাঠদান নিচ্ছে বর্তমানে ১৬৭ জন। বাকি শিক্ষকরা রয়েছেন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে শিক্ষা ছুটিতে। গড়ে ৫৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র একজন শিক্ষক। কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে মোট ২৭৩ জন।
হিসেব করে দেখা যায় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বিভাগ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যানুযায়ী খুবই নগণ্য। যেখানে অর্গানোগ্রামভুক্তে ৪৫৩ জন শিক্ষক থাকার কথা সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ছাড়কৃত ২১০ জন। আবার শীর্ষ তিন পদসহ ২২টি পদই শূন্য রয়েছে। যার কারণে সবকিছুর গতিশীলতা আনা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এত শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তা কম আবার অভিভাবক শূন্য।
একটি সূত্র বলছে, অর্গানোগ্রামের হিসাব অনেক আগের। এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, তাই শিক্ষকসহ জনবলের চাহিদাও বাড়বে। দ্রুত পূর্ণাঙ্গ উপাচার্য নিয়োগ পেলে এগুলো বাস্তবায়ন করে সংকট মোকাবিলা করতে পারবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক শিক্ষক জানান, আমাদের শিক্ষক সংকট রয়েছে, অধ্যাপক রয়েছে একজন। এজন্য বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হোক।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের শিক্ষক সংকট থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছি। প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক এ ব্যাপারে আন্তরিক। তবে নিয়মিত উপাচার্য ও অন্যান্য দপ্তরের পদ পূরণ না হলে কিছুটা দাপ্তরিক কাজ ব্যাহত হয়।
শীর্ষ পদ পূরণ ও গতিশীলতার বিষয়ে মতামত জানতে কথা হয় অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তার মধ্যে ইংরেজি বিভাগের মো. তারিক হোসেন বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একজন অধ্যাপক। তাই আমরা দ্রুত পূর্ণাঙ্গ একজন উপাচার্য চাই। যিনি ঢাকা বা অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা দেখবেন ও সমাধান করবেন। সঙ্গে উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদের নিয়োগ দিলে আরও বেশি এগিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ শিক্ষক কোরাম রয়েছে, তাই বাইর থেকেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হোক।
এদিকে দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে সমালোচনা ও বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে। উপাচার্য নেই অথচ প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দীন বিভিন্ন শাখায় বা দপ্তরে দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রক্টরিয়াল বডির অবর্তমানে তড়িঘড়ি করে শৃঙ্খলা কমিটি করা হয়। পরে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরিপত্রটি বাতিল করে।
এ ছাড়া চার হলের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিকে ডিনের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি নিজেই। এসবে ছাত্র-শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব থাকা অধ্যাপকের বিরুদ্ধে। দায়িত্ব দেওয়া সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুযায়ী জরুরি সিদ্ধান্ত, যাতে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত থাকে।
মন্তব্য করুন