‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে আহত হলেও আমার কোনো কষ্ট নেই। কারণ তাদের কষ্ট এবং ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বৈরাচারী সরকার থেকে মুক্তি পেয়েছি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক, পুলিশের গুলিতে আহত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র তৌহিদ ইসলাম তানভীরের বাবা সুরত আলম মুঠোফোনে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) এ প্রতিক্রিয়া জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিক্ষোভ সমাবেশ করার সময় গত ৩ আগস্ট নগরীর দামপাড়াস্থ ওয়াসা মোড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি।
তৌহিদুল ইসলাম তানভীরের (২৩) তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রামু উপজেলায়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার দিনের দুর্বিষহ স্মৃতির কথা বাসসকে বর্ণনা করতে গিয়ে তানভীর বলেন, ‘কোটার মারপ্যাঁচে আমাদের মেধাবী ছাত্রদের সরকার বঞ্চিত করে আসছিল।
আমরা ১ জুলাই থেকে এই যৌক্তিক আন্দোলন শুরু করি। ছাত্রজীবন শেষে মেধাবীরা যেন যথোপযুক্ত স্থানে চাকরির সুযোগ পান, কোটার চোরাবালিতে আমাদের সোনালি ভবিষ্যতের যেন অপমৃত্যু না ঘটে তার জন্যই আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম। ১ জুলাই শুরু হলেও মধ্য জুলাই থেকে সারাদেশের সর্বস্তরের ছাত্ররা এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ধীরে ধীরে তুঙ্গে ওঠে। আমরা নিয়মিত শান্তিপূর্ণভাবে মিটিং-মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ করে আমাদের প্রাণের দাবি সরকারের কানে তোলার চেষ্টা করছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকার সমন্বয়কদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে আমরা আমাদের ভার্সিটিতেও যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছিলাম। আমাদের সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষও আন্দোলনে যোগ দেন। স্বাভাবিকভাবে দেশের আপামর জনসাধারণকে পাশে পেয়ে আমরা আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হই। সারাদেশ যখন আন্দোলনে উত্তাল এবং কেন্দ্র থেকে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণার পর আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের ষোলশহরে বাংলা ব্লকেড পালনের সিদ্ধান্ত নিই।
শত শত শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রেনে করে ষোলশহর স্টেশনে নেমে মিছিল শুরু করি। আমরা ২ নং গেটে পৌঁছালে পুলিশ আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের ছোড়া অসংখ্য রাবার বুলেট আমার পা ও শরীরে বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত আহত অবস্থায় আন্দোলনের সহযোদ্ধারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।’
আহত সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে তানভীর বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের মুখে এর দুই দিন পর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমার আবেদন থাকবে, এই আন্দোলনে অসংখ্য শিক্ষার্থী হামলার শিকার হয়েছে, সরকার তাদের প্রতি যেন সবসময় সদয় থাকে। যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের যেন যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আন্দোলনে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারকে যেন সরকার সব কিছুতে সহযোগিতা করেন।’
তানভীর একইসাথে দেশের সর্বস্তর থেকে বৈষম্য দূর করে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের আকুতিও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ ১৬ বছরের অরাজকতা এবং বর্তমান অর্থনৈতিক দূরাবস্থা দূর করে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমার মতো দেশের সব মানুষই প্রত্যাশা করে, ভেদাভেদহীন রাষ্ট্র ও সমাজ এবং নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সবকিছুতে থাকবে সুষম বণ্টন। একইসাথে ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের আন্দোলন হয়েছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাই বৈষম্যহীন রাষ্ট্র কায়েম করা গেলে আন্দোলনে নিহত-আহত সকলের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে।’
আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করে তানভীর বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আমাদের চিকিৎসার ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে আমাদের দেখে গেছেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতাকর্মী, আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের বিবেকবান ব্যক্তিবর্গ আমাদের এখানে এসেছেন। তারা সকলে আমাদের সাথে অত্যন্ত সহানুভূতি নিয়ে কথা বলেছেন, আমাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন। চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে আমাদের যেন উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় সে ব্যাপারে প্রযোজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।
বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার সাহসী সৈনিক তানভীর অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের দেখতে আসা ব্যক্তিবর্গ এবং দেশের আপামর জনসাধারণকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে তানভীরের বাবা সুরত আলম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পরিবারে আমার ৫ সন্তানের মধ্যে তানভীর চতুর্থ। তিনি বলেন, আমি একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। আমি অনেক কষ্ট করে আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছি। কিন্তু এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে আহত হলেও আমার কোন ক্ষোভ নেই। কারণ তাদের কষ্ট এবং ত্যাগের বিনিময়ে আজকে আমরা এই স্বৈরাচার সরকার থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমি এই অন্তবর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই তারা আমার ছেলেসহ যারা আহত এবং যারা নিহত হয়েছে তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য।
মন্তব্য করুন