ছাত্রলীগের রাজনীতি, দলীয় কর্মকাণ্ড, মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার শর্ত ছাড়া সিট মিলত না সরকারি কেশব চন্দ্র কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ভর্তির নামে ভাড়া ছাড়াই কলেজের আবাসিক হলে থাকতেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীদের রেখে যাওয়া এক বছরের হল ভাড়া বাবদ ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, তিন মাসের ১৮ হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল এবং ৮ মাসের ইন্টারনেট বিল বকেয়া থাকারও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি হলের দুপাশে থাকা বিভিন্ন দোকানেও দলীয় কর্মসূচি বাবদ চাঁদা দাবিও করেন তারা।
ঝিনাইদহ সরকারি কেশব চন্দ্র (কেসি) কলেজ কর্তৃপক্ষ ও কলেজের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ছাত্র হলের সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৫ সালের মে মাসে শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ১০০ আসনবিশিষ্ট একটি আবাসিক হোস্টেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়। সে সময় হলে শিক্ষার্থী, ছাত্রদলের ছেলেরা থাকত। নিয়ম অনুযায়ী সিট প্রতি মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। শুরুতে হল সুপারের কাছে আবেদন এবং এক বছরের অগ্রিম ভাড়া দিতে হয়। সেই টাকা দিয়েই হলের মেইনটেন্যান্স, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য ব্যয় বহন করা হয়।
পরবর্তী সময়ে ১-১১ (তত্ত্বাবধায়ক সরকার)-এর সময় হলটি ফাঁকা হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আনুমানিক ২০১১ সালের দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা থাকতেন। কয়েক বছর পর আবারও ফাঁকা হয়ে যায় হলটি। অভিযোগ, তারাও নিয়মিত ভাড়া দিতেন না। দুই লক্ষাধিক টাকার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখে হল ছেড়েছিলেন। ফাঁকা থাকার এই সময়ে চুরি হয়ে যায় হলের অনেক ফ্যান ও আসবাব। এরপর ২০১৬ সালে তিন তলা, পর্যায়ক্রমে ২০১৮ সালে চার তলা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে পঞ্চম তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয় নতুন আরেকটি ভবন। পুরোনো এবং নতুন ভবন মিলিয়ে এখানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে ২৪০ জন ছাত্রের।
জানা যায়, কলেজে এইচএসসি, ডিগ্রি, অনার্স, মাস্টার্স মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১১ জন। এর মধ্যে ছাত্রসংখ্যা ৭ হাজার ১৩৮ জন।
পরে ২০১৯ সালে কলেজের শিক্ষক কাউন্সিলে ফের হলটি চালুর সিদ্ধান্ত হয়। ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবেন আশ্বাসে ১০ থেকে ১৫ জন সাধারণ শিক্ষার্থী থাকা শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীসংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫ জনে। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালের মার্চ মাসে হল ছাড়েন ওই শিক্ষার্থীরা।
এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি সজীব হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক আল ইমরান ও সরকারি কেসি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হোসাইন ম. ফরহাদ, সাধারণ সম্পাদক মাহতাসিম বিল্লাহ জিসান বারবারই হোস্টেল চালুর বিষয়ে জানাতে থাকেন।
শিক্ষকরা সাফ জানিয়ে দেন, হলে কোনো রাজনীতি চলবে না এবং সর্বনিম্ন ১০০ জন ছাত্র হতে হবে। কিছুদিন ঘুরে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক নিয়ে ৬ মাসের ভর্তি ফি দিয়ে আবাসিক হলে ওঠেন তারা। তখন থেকেই ভর্তি ছাড়াই ফ্রিতে থাকতেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হোসাইন ম. ফরহাদ। সেখানে হোস্টেল সুপারের পক্ষ থেকে একজন শিক্ষার্থীকে ম্যাচ ম্যানেজার করা হলেও অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগে কয়েকদিন পরই ম্যানেজার বাতিল করে ছাত্রলীগ।
ক্রমান্বয়ে হলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের কাছে। এক রকম নিরুপায় হয়ে পড়েন হল সুপার। ছয় মাস পর থেকে ওই আবাসিক ছাত্ররা আর ভর্তি ফি দেননি। পরে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ১৫ জন নতুন ছাত্র হোস্টেলে ওঠান তারা। এর মধ্যে মাত্র ৭ জন ছয় মাসের ভর্তি ফি দিয়েছিলেন।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা হলে থাকা ছাত্রলীগের কক্ষগুলো ভাঙচুর করে। সরেজমিন হোস্টেলটিতে গিয়ে মেলে এমন চিত্র। এ ছাড়া সিঁড়ির নিচে পাওয়া যায় সরকারদলীয় ছাত্রলীগের প্ল্যাকার্ড।
এসব বিষয়ে কথা বলতে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হোসাইন ম. ফরহাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহতাসিম বিল্লাহ জিসান জানান, ‘কিছু সমস্যা ছিল। সেগুলো সমাধানের দিকে এগোচ্ছিলাম। ছাত্রদের নিয়ে মিটিং ডাকতেও বলা হয়েছিল সভাপতিকে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটের কারণে আর হয়নি। হলে আমি কখনো থাকিনি। আমার ৩ থেকে ৪ জন কর্মী থাকত। মূলত সভাপতি ফরহাদ ও তার কর্মীরা সেখানে থাকত।’
সম্প্রতি সরকারি কেসি কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন অলোক অধিকারী। বুধবার দুপুরে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে তিনি বলেন, ‘হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শাখারিদহ গ্রামে আমার বাড়ি। কৃষক পরিবারের সন্তান আমি। মেসে থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ করেছি; কিন্তু হলে থাকিনি। কারণ হলে থাকলেই রাজনীতি করতে হতো।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাভিদ শাহরিয়ার সাফিন জানান, ‘কলেজের হলে সিট পেতে হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো। এরপর তারা পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জানত। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আগ্রহ আছে কি না সেটাও জানা হতো। সব মিছিল-মিটিং এবং রাজনৈতিক কাজে যেতে পারলে হলে ওঠা যেত। মিছিল-মিটিংয়ে বাধ্যতামূলক যেতে চাপ দেওয়া হতো। এজন্য হলে থাকেননি তিনি।’
আবাসিক হলের সামনের অনেক দোকানি জানান, ছাত্রলীগের ছেলেরা এসে বলত দলীয় কর্মসূচি আছে, সেখানে টাকা লাগে। দোকানভেদে এক থেকে চার হাজার টাকা দাবি করত তারা। কলেজের অনেক শিক্ষক বলেন, ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যদি ফের চেষ্টা করে হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নতুন করে দরিদ্র, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে অনেকেই আসবে এবং এমন হবে যে শিক্ষার্থীর চাপে আসন বাড়ানো লাগছে।’
সরকারি কেসি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান আবাসিক ছাত্র হলের তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শেষদিকে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় হলটি। বারবার তাদের ভর্তি হওয়া ও বকেয়া পরিশোধের জন্য বলা হলেও সময়ক্ষেপণ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চলতি মাসের ৫ তারিখের পর আর কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে যদি শিক্ষক কাউন্সিলে হলটি চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, তখন পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
মন্তব্য করুন