সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারাদেশে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও প্রক্টর থেকে শুরু করে প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা অনেকেই পদত্যাগ করছেন। গত কয়েকদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য, প্রক্টর ও হল প্রভোস্টসহ অনেকেই পদত্যাগ করেছেন।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে গতিশীল করার লক্ষ্যে খালি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শীঘ্রই পূরণ করার কথা ভাবছে নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর মধ্যে, উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলের মাঝে বেশ উদ্দীপনা কাজ করছে।
এবার ঢাবির উপাচার্য হিসেবে বেশ কয়েকজন গুনী শিক্ষককে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। তারা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন।
সার্বিক দিক বিবেচনায় এবার উপাচার্য হওয়া নিয়ে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন ড. নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের একাডেমিক অ্যাডভাইজার এবং আরণ্যকের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েলস সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভের দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো - তিনি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। যার কারণে, তিনি উপাচার্য হিসেবে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পছন্দের তালিকায় থাকার সম্ভাবনা বেশি।
ঢাবির এক শিক্ষক বলেন, অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ প্রজ্ঞা ও পেশাদারিত্বের দিক থেকে অনন্য। তাকে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সভায় যেতে দেখিনি। তিনি উপাচার্য হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ও গৌরব উদ্ধার করতে পারবেন বলে আশা করা যায়।
এরপর আলোচনায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের সাবেক আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) - এর সভাপতি অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম। সাদা দলের শিক্ষকদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠতা, প্রশাসনিক ও একাডেমিক যোগ্যতা, ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের ওপর ভিত্তি করে তিনি বেশ এগিয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে, সাদা দলের বর্তমান যুগ্ম-আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খানও আলোচনায় রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের দুই দুইবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া অধ্যাপক ছিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর এবং ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে দীর্ঘ সাড়ে ৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এর বাইরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়, দেশ ও সমাজের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় সময়ই বিভিন্ন টকশোতে কথা বলতে দেখা যায়।
তাদের দুইজনের ব্যাপারে ঢাবির এক শিক্ষক বলেন, অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম এবং সিদ্দিকুর রহমান যোগ্যতা ও সততার দিক থেকে ভাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক। তারা দুইজন বিএনপিপন্থি শিক্ষক হলেও বিভিন্ন বিষয়ে বেশ নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখেন।
জনপ্রিয়তা ও পরিচিতির দিক থেকে বামপন্থি শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান এবং ড. মো. কামরুল হাসান মামুন বেশ আলোচনায় রয়েছেন। তাদের নিজ নিজ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন সময়ে উভয়ের ব্যাপারেই একাডেমিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রশংসা শোনা যায়। ক্যাম্পাসে তারা শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক হিসেবে বেশ পরিচিত। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলন ও মানবাধিকার প্রশ্নে তাদেরকে বেশ জোড়ালো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। তবে তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে ধর্মচর্চা করেন এমন মুসলিম শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে বিদ্বেষী মনোভাব পোষণের অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের বড় একটা অংশ, বিশেষ করে ডানপন্থি ছাত্র-শিক্ষকরা তাদের উপাচার্য হওয়াকে ইতিবাচকভাবে নেবে না বলে বুঝা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে আয়মান মুনীর নামে ঢাবির এক শিক্ষার্থী বলেন, সম্প্রতি শহীদ মিনার এলাকায় আরবি ক্যালিওগ্রাফি করতে আসলে কিছু শিক্ষার্থীদের আটকে রেখে ও ব্যক্তিগত তথ্য চেক করে ‘জঙ্গি’ ট্যাগ দেন তানজীম স্যার। অন্যদিকে, কামরুল হাসান মামুন স্যার বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় তিনি জঙ্গি বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কমেন্ট করতে দেখা গেছে। আবার জনপ্রিয় এক ইসলামিক বই নিষিদ্ধ করে দেওয়ার জন্য দাবি তুলতে দেখা গেছে তাকে।
কেমন গুণাবলির ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্য হিসেবে দেখতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যিনিই আসবেন তার উচিৎ হবে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, জীবনমান উন্নয়ন ও আবাসন ব্যবস্থায় নজর দেওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইমেরিটাস অধ্যাপক কালবেলাকে বলেন, আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে এমন কেউ আসুক, যিনি নিঃসন্দেহে পন্ডিত ব্যক্তি এবং যখন দায়িত্ব পালন করবেন তখন তিনি নির্দলীয় হয়ে কাজ করবেন। যদি রাজনৈতিক কোনো দলেরও থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে এসে তিনি যেন সবার হয়ে যাবেন।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন কোটা বাতিলে ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ওইদিন থেকেই ৯ জুন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ঈদ ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হলে গত ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ফের ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়।
এক পর্যায়ে ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করে। গত ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যের জের ধরে রাতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এদিন ঢাবিসহ ছাত্রলীগের বহিরাগতদের হামলায় অন্তত ৩০০ আন্দোলকারী আহত হন। এর জেরে ১৬ জুলাই ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক রণসাজে সজ্জিত হয়ে অবস্থান করেন। এদিন কিছু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীর হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকারী প্রক্টর আহত হন। এদিন রাতেই শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে একাধিক প্রাধ্যক্ষ নিজ নিজ হলকে রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হন। পরের দিন (১৭ জুলাই) সকালে আরও কয়েকটি হলের শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কক্ষ ভাঙচুর ও হামলা করে হলগুলোকে ছাত্রলীগমুক্ত করেন এবং এসব হলের প্রাধ্যক্ষরাও নিজ নিজ হলকে রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করেন।
এদিকে বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আয়োজিত কফিন মিছিলে পুলিশের গুলি, সাউন্ড গ্র্যানেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৭ জুলাই সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং একাডেমিক পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হামলার ঘটনার জেরে ১৭ জুলাই থেকেই তৎকালীন উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তাদের পদত্যাগের দাবি উঠে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই দাবি আরও জোরালো হয় এবং ৮ ও ৯ আগস্ট বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। পরে গত ১০ আগস্ট অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগের খবর শোনা যায়। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, রোকেয়া, শামসুন নাহার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ এ হলের আরও চার হাউজ টিউটর এবং নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছাত্রীনিবাস ওয়ার্ডেন ভাইস চ্যান্সেলর অফিসে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর আগে গত ৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ প্রক্টরিয়াল বডির ১৪ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেন।
মন্তব্য করুন