ঈদের খুশিতে যখন দেশ ভাসছিল তখন কোরবানির জন্য এক ছাগল কিনে পাগল হয়ে লুকিয়ে ছিল রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান, তার ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতসহ তাদের পরিবারের লোকেরা। এক ছাগলকাণ্ডে মতিউর রহমানের পুরো পরিবারে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। সব বাসার মূল ফটক বন্ধ, খুলে রাখা হয়েছে নেমপ্লেট। রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত কোথায়– নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ।
ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডে ইম্পেরিয়াল সুলতানা ভবনের পাঁচতলায় থাকেন মতিউর রহমান। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী জানান, মঙ্গলবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি তারা। ইফাতের ছাগলকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ধানমন্ডির বাসা ছেড়ে কাকরাইলে নিজেদের আরেকটি ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠেন ইফাত, তার মা শাম্মী আখতার ও ছোট ভাই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, ইফাত তার মাকে নিয়ে ইতোমধ্যে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। ছাগলকাণ্ডের পর ছেলেকে অস্বীকার করেও এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর দায় এড়াতে পারেনি। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে মতিউর গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এত সম্পদ মতিউরের যে, সে কোনো বাসায় আছে তা খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর! বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৭/এ নম্বর রোডের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে ৫ কাঠা আয়তনের প্লটে তৈরি করা সাততলা ভবনের এক ফ্লোরে বাস করেন মতিউর রহমান ও তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি।
ছাগলকাণ্ড ছাপিয়ে এখন আলোচনায় মতিউরের সম্পদ। একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন– উঠেছে সেই প্রশ্ন। মতিউরের সম্পদের বিষয়ে পাওয়া গেছে নানা তথ্য। দুর্নীতি দমন কমিশনও মতিউরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
মতিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদীতে; সেখানে পান্নু হিসেবে পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স করার পর এমবিএ করেন। ১৯৯০ সালে চাকরি নেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনে। ১৯৯৩ সালে ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কাস্টমসে যোগ দেন এবং ২০১৫ সালে কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্বে থাকাকালে শুরু হয় তার উত্থান।
অনুসন্ধানে মতিউর রহমানের অঢেল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। নরসিংদী, ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়াও গাজীপুরের পূবাইলে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো, জমিসহ নামে-বেনামে রয়েছে অনেক জমি ও স্থাপনা। বরিশালেও রয়েছে তার সম্পদ। ঢাকায়ও আছে একাধিক প্লট ও দামি গাড়ি। স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদ গড়েছেন মতিউর।
ঢাকায় মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে ২ ডজন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা যায়। গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তার ৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে কেনা হয়েছে। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা আছে তার। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে মতিউরের। ময়মনসিংহের ভালুকার গ্লোবাল শুজ লিমিটেড নামে জুতার ফ্যাক্টরি। শুধু ভালুকা নয়, গাজীপুরের পূবাইলেও রয়েছে মতিউর রহমানের বিশাল সাম্রাজ্য। পূবাইলের খিলগাঁওয়ের টঙ্গী-ঘোড়াশাল সড়কের দক্ষিণ পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তুলেছেন ‘আপন ভুবন’ পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট। নিজ এলাকা মুলাদী উপজেলায় বাড়িঘর ছাড়াও তার নামে প্রায় ১ হাজার ৫০০ বিঘা জমি রয়েছে।
প্রাডো, বিএমডব্লিউ, রেঞ্জ রোভারসহ বিলাসবহুল ৮ থেকে ১০টি গাড়ি আছে তাদের। তবে প্রায় সব গাড়ির মালিকানা তাদের বিভিন্ন কোম্পানির নামে। এ ছাড়া তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
মন্তব্য করুন