দুর্ধর্ষ সেই প্রতারক আশরাফুজ্জামান মিনহাজের প্রতারণার আরও নানা কাহিনি বের হয়ে আসছে। নিজের পিতা-মাতা ও আপন ভাই-বোনকেও ছাড়েননি ভয়ঙ্কর এই প্রতারক। সম্পত্তি দখলে নিতে নিজের পিতা-মাতা ও আপন বড় ভাই-বোনকেও ৯ মামলার আসামি বানিয়েছেন তিনি। ভুক্তভোগীরা সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে বিচার চেয়েও বিচার পাননি।
প্রতারক মিনহাজের ৭২ বছর বয়সী পিতা হারুন অর রশিদ অভিযোগ করে বলেন, মিনহাজ তার সম্পত্তি দখল করতে না পেরে তাকে নির্যাতনের পাশাপাশি বৃদ্ধ বয়সে জেলে পাঠিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও তিনি ন্যায়বিচার পাননি। নিজ সন্তান আশরাফুজ্জামান মিনহাজ ওরফে মিনহাজ উদ্দিনের মামলা ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন তিনি। তবুও রেহাই মিলেনি। কারণ আইন-আদালত, প্রশাসন সবই যেন চলত মিনহাজের কথায়।
ভুক্তভোগী পিতা আরও বলেন, বিভিন্ন মামলায় আসামি বানানোর পাশাপাশি পুলিশ দিয়ে তাকে থানায় নিয়ে চালানো হয়েছে নির্যাতন। হুমকি দেওয়া হতো পেশাদার খুনিদের দিয়ে শেষ করে দেওয়ার। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি কুলাঙ্গার ছেলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন পিতা হারুন অর রশিদ।
প্রতারক মিনহাজের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মিরওয়ারিশপুরে। এলাকার মানুষ তার ভয়ে আতঙ্কে থাকত সবসময়। কারণ মিনহাজের রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। অভিযোগ আছে এসবের পেছনে রয়েছে তার বিসিএস ক্যাডার স্ত্রীও। মিনহাজ পুলিশ দিয়ে বড় ভাইকে পিটিয়ে ভিডিও করে দেখাত বাবাকে; হুমকি দেওয়া হতো তার পরিণতও এমন হবে। মা-বোনকেও পিটিয়েছেন তিনি।
গত ২৬ মার্চ ভোরে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় প্রতারক আশরাফুজ্জামান মিনহাজকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী। বর্তমানে তিনি শরীয়তপুর কারাগারে বন্দি। পুলিশ জানিয়েছে, তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতারক মিনহাজের বিকৃত নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তার বড় ভাই হাসানুজ্জামান বলেন, আমাকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ভিডিও করে আমার বাবাকে দেখিয়ে তাকেও ভয় দেখাত। বাবাকে বলতো- তুই যদি তোর ছেলের পক্ষে কথা বলিস তাহলে তোকেও এভাবে মেরে ফেলব। এরপর বাবা আর কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। হাসানাজ্জামান আরও বলেন, তার বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে ছিল যা কল্পনাও করা যায় না। বাবা-মা, ভাই-বোন ও সমাজের যেই তার বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাকেই নির্যাতন করেছে মিনহাজ। তার পেছনে প্রশাসনের প্রভাবশালী কোনো কর্মকর্তার ইন্ধন ছিল বলেও জানান হাসানুজ্জামান।
গত মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) ‘দুর্ধর্ষ এক প্রতারকের নাম আশরাফুজ্জামান মিনহাজ’ শিরোনামে দৈনিক কালবেলা পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, নতুন নতুন কায়দায় প্রতারণা করে অর্থ কামান তিনি। সুবিধা অনুযায়ী কখনো নিজেকে পরিচয় দেন কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক। আবার কোথাও বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। বর্তমানে নিজেকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর দাবি করেন। নিজেকে বিত্তবান পরিচয় দিয়ে সুইস ব্যাংকে ৫৫ মিলিয়ন ডলার গচ্ছিত আছে বলেও দাবি তার। বিসিএস ক্যাডার ‘কথিত’ স্ত্রীর প্রভাব দেখিয়ে ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলার আসামি করে আবার ভুক্তভোগীদের সহযোগিতার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই তার মূল পেশা। প্রতারক মিনহাজ ও তার স্ত্রীর এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছেন একজন ভুক্তভোগী।
জানা গেছে, আশরাফুজ্জামান নামের এই প্রতারকের উত্থান ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগেই তার পরিবারের এক সদস্যকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন মিনহাজ। এরপর ২০০৯ সালে সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তার পরিবারের জামাই পরিচয় দিয়ে সচিব, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করেন তিনি। নিজে পুলিশ, আমলা ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে মামলায় ফেলে আবার মামলা থেকে বাঁচানোর নামে ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে টাকা আদায় তার প্রধান পেশা হয়ে ওঠে। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের বিপদে ফেলেও টাকা নেন তিনি। অপরাধ করতে যখন যাকে প্রয়োজন তাকে ব্যবহার করেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের পরিবারের জামাই পরিচয় ব্যবহার করার ঘটনা জানতে পেরে তাকে তখন গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
সম্প্রতি নতুন পন্থা অবলম্বন করে অর্থ কামানোর ধান্দায় নেমেছেন তিনি। পতিত স্বৈরাচারের ১৬ বছরে বিএনপি-জামায়াতপন্থি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও ভালো পদায়ন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন- এমন আশঙ্কায় ওই কর্মকর্তারা তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
মন্তব্য করুন