সুশোভন অর্ক
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ এএম
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা দিয়ে কিনতেন জুম্মান

আব্দুল হামীদ জুম্মান।
আব্দুল হামীদ জুম্মান।

একসময় মিরপুর-১ নম্বর এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন বাসের হেলপার ছিলেন মো. আব্দুল হামীদ জুম্মান। তবে এই পেশায় যেন মন বসেনি তার। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় গিয়ে তাদের প্রভাব খাটিয়ে শুরু করেন চাঁদাবাজি। সে জন্য নিজের ছোট ভাই আব্দুর রহিম এবং ছেলে নাজমুল হোসেনকে নিয়ে তৈরি করেন চক্র। হয়ে ওঠেন ওই এলাকার পরিবহন মাফিয়া। চাঁদাবাজির টাকায় গড়ে তুলেছেন বাড়ি, জমি ও প্লট।

আওয়ামী লীগের নেতাদের ম্যানেজ করে একসময় প্রভাব খাটালেও রাজনৈতিক ভোল পাল্টে এখনো দোর্দণ্ডপ্রতাপে চলছে জুম্মানের চাঁদাবাজি। বাস, লেগুনা এবং অন্যান্য যানবাহন ছাড়াও ফুটপাত থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন তিনি। জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে অর্থ সহায়তার পাশাপাশি মিরপুর এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছেন জুম্মান। এ ছাড়া আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী মোছা. রিতা আক্তার হত্যার ঘটনায় মিরপুর মডেল থানার মামলার আসামি হলেও প্রকাশ্যে রয়েছে জুম্মান চক্র।

জানা যায়, পরিবহন মাফিয়া হিসেবে জুম্মানের উত্থান প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবং মিরপুর-১৪ আসনের সাবেক এক এমপির হাত ধরে। ওই এমপির যে কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা দিতেন তিনি। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতা এবং পুলিশকে টাকা দিয়ে সবসময় ম্যানেজ করতেন জুম্মান। মিরপুর পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করার সুবাদে একসময় জুম্মানের পরিচয় হয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে। তার সংস্পর্শে এসে বাগিয়ে নেন মিরপুর থানা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এই পদের প্রভাব খাটিয়ে মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স মার্কেটকেন্দ্রিক সংগঠন মুক্তবাংলা বহুমুখী কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদকও হন তিনি। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর হয়ে চলাচলকারী সব যানবাহনকেই চাঁদা দিতে হয়। পাশাপাশি মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে সিঁড়ি এবং ফুটপাতে থাকা প্রায় অর্ধসহস্র দোকান থেকে বিভিন্ন রেটে চাঁদা তোলেন জুম্মান। ওই অঞ্চলের আগা খান মিন্টু এমপি হলে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন জুম্মান। একই নিয়মে আগা খান মিন্টুর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা দিতেন তিনি। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে মাইনুল হোসেন খান নিখিল প্রার্থী হলে, তার নির্বাচনী প্রচার এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্রায় অর্ধকোটি টাকা খরচ করেন। নিখিল এমপি হলে জুম্মান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে তার আপন ছোট ভাই আব্দুর রহিমকে এই সংগঠনের সভাপতি পদে বসান। এদিকে তার ছেলে নাজমুল হোসেন নিজেকে সাংবাদিক এবং মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী হিসেবে এলাকায় নিজেকে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। ভুয়া সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে হুমকি এবং ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করেন তিনি। এ ছাড়া মিরপুর-১ নম্বর এলাকার যানবাহন এবং মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের চাঁদাবাজিকাণ্ডে বাবার ডান হাত হিসেবেও কাজ করেন নাজমুল।

মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় জুম্মান আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজি করলেও বর্তমানে স্থানীয় বিএনপি নেতা এবং পুলিশকে ম্যানেজ করে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। কমপ্লেক্সের সামনে ফুটপাত এবং রাস্তা দখল করে প্রায় পাঁচশ দোকান বসিয়েছেন তিনি। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন তিনি। এ ছাড়া মার্কেটের স্পেস দখল করেও দোকান ভাড়া দিয়েছেন জুম্মান। এসব দোকান থেকে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। সম্প্রতি জুম্মানের চাঁদাবাজির একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, জুম্মান মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের একটি দোকানে গিয়ে বসেছেন। এর কিছুক্ষণ পরই ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা তার কাছে লাইন ধরে টাকা দিয়ে যাচ্ছে। কেউ সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তাদের নির্ধারিত টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে।

মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের এক ব্যবসায়ী জানান, জুম্মান তার ভাই এবং ছেলেকে নিয়ে এই এলাকায় পুরো চাঁদাবাজি চক্র নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো ব্যবসায়ী যদি কোনোদিন চাঁদার টাকা না দিতে পারেন, তাহলে লাথি দিয়ে তার দোকান ফেলে দেওয়া হয়। গালাগাল করা হয়। কোনো কোনো সময় বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়। মার্কেটের কোনো দোকানের মালিক যদি নিজের দোকান ডেকোরেশন কিংবা মেরামত করতে চান, তাহলেও জুম্মানকে এক থেকে দুই লাখ টাকা চাঁদা দেওয়া লাগে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি বন্যার সময় তার ছেলে নাজমুল নামে মাত্র একটি ফাউন্ডেশন খোলে। সেখানে সবাইকে ত্রাণের জন্য টাকা দিতে বাধ্য করে। এসব টাকা ত্রাণ হিসেবে গিয়েছে কি না আমরা জানি না। আরেক ব্যবসায়ী মো. সজীব বলেন, জুম্মানের চাঁদাবাজির যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। চাঁদা না দিলেই মারধর এবং হুমকি দেওয়া হয়। এর আগে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে তিনি এসব চাঁদাবাজি করতেন। বর্তমানে তিনি বিএনপি নেতাদের প্রভাব দেখিয়ে এসব চাঁদাবাজি করছেন।

জুম্মানের যত সম্পদ

একসময় বাসে হেলপার করে জীবনযাপন করা জুম্মান এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় এফ ব্লকে ছয় তলা বাড়ি, মিরপুর-২ নম্বর রোডে দুটি ফ্ল্যাট, মিরপুর-১ নম্বর রোডে জনতা হাউজিংয়ে ১৬২ নম্বর বাসায় একটি ফ্ল্যাট, গুদারাঘাট ১১ নম্বর রোডে এইচ ব্লকে ২০ নম্বর বাসায় একটি ফ্ল্যাট, দক্ষিণ বিশিল এলাকায় ৯ নম্বর রোডে ৫৯ নম্বর বাসায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে জুম্মানের। এ ছাড়া সাভার ডগের মোড় এলাকায় একটা বাড়ি এবং ফরিদপুর আটরশি খানকার পেছনে একটি বাংলো বাড়ি রয়েছে তার। এসব ছাড়া মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের ৮২ নম্বর দোকানের মালিক তিনি এবং মার্কেটের পঞ্চম তলায় ছয়টি স্পেস কিনে ভাড়া দিয়েছেন।

ছাত্র-জনতা আন্দোলন দমনে গুলি এবং হত্যা মামলার আসামি

গত জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে মাঠে নামেন জুম্মান। সে সময় তিনি আন্দোলন দমাতে টাকা দিয়ে মদদ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া শত শত লোকের মিছিল নিয়ে ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিলেন জুম্মান। মিছিলে নিজে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলিও করেন জুম্মান।

স্থানীয় ছাত্রদল নেতা আশরাফুল ইসলাম জানান, মিরপুর এক নম্বর, চিড়িয়াখানা এলাকা এবং পল্লবী এলাকায় জুম্মান এবং তার লোকজন ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। আমরা এই আন্দোলনে রাস্তায় ছিলাম। জুম্মান এবং তার লোকদের তাণ্ডব নিজ চোখে দেখেছি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন মিরপুর রূপনগর এলাকায় দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজের এইচএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থী মোছা. রিতা আক্তারকে গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রিতা আক্তার এই আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। এই ঘটনায় রিতার বাবা মো. আশরাফ আলী মিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলার অন্যতম আসামি জুম্মান। তবে সরকার পতনের পর প্রেক্ষাপট বদলালেও হত্যা মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জুম্মান।

মিরপুর মডেল থানার ওসি মো. গিয়াস উদ্দীন মিয়া বলেন, কোনো আসামি যদি এভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় কিংবা হুমকি দেয়, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চাঁদাবাজির অভিযোগ এবং আন্দোলনে গুলি চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আব্দুল হামীদ জুম্মান বলেন, আমার নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ মিথ্যা। আমি আওয়ামী লীগ করতাম না কখনো। আমাকে বিএনপির সব বড় বড় নেতা চেনেন। হত্যা মামলার আসামির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন আসামি অনেককেই করা হয়েছে। আমি কেমন, সেটা সবাই জানে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় জালের কনসার্ট পণ্ড

বৃষ্টি ও আলোকস্বল্পতায় বন্ধ প্রথম দিনের খেলা

গণহত্যাকারীদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই: জামায়াত আমির

ভারি বর্ষণে বন্যা হতে পারে যে ৪ জেলায়

মুন্সীগঞ্জে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চালক নিহত

আসছে রাফীর আরও একটি থ্রিলার

টুঙ্গিপাড়ায় বিএনপির কর্মিসভা অনুষ্ঠিত

প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করে নীতিমালা করা হবে : আসিফ নজরুল

বর্ণালীর ‘সেই মানুষটা তুমি’

বছরের শেষে ঢাকায় আসছেন আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি

১০

ভারতীয় দর্শকদের সঙ্গে হাতাহাতি, হাসপাতালে টাইগার রবি

১১

আমেরিকান বাংলাদেশি প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের যাত্রা শুরু

১২

বাকৃবিতে আসছেন না সামিনা লুৎফা, আলোচনাসভা স্থগিত

১৩

গম্ভীরের চেয়ারে ক্যারিবীয় ‘চ্যাম্পিয়ন’

১৪

একযুগ পর একসঙ্গে পর্দায় সাইফ-কারিনা

১৫

প্রথম সেশন শেষে স্বস্তিতে বাংলাদেশ

১৬

দিনাজপুরে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড

১৭

শিক্ষার্থীদের জন্য রাস্তা সংস্কারে ছাত্রদল

১৮

পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে ইসলামি বিশেষজ্ঞ না থাকায় উদ্বেগ 

১৯

আজারবাইজানের আকাশ কাঁপাবে পাকিস্তানি জেএফ-১৭

২০
X