ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার (৬ মে) এই আদেশ দিয়েছেন।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বেসরকারি ফলে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকূপা) নৌকার প্রার্থী আব্দুল হাইকে বিজয়ী ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। কিন্তু আবদুল হাই গত ১৬ মার্চ ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মারা যান। তার মৃত্যুতে আসনটি ওইদিনই শূন্য হয়। শূন্য হওয়া আসনে আগামী ৫ জুন ভোটগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
কিন্তু ওই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ ও ভোট গণনায় অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে ঝিনাইদহ-১ আসনের এমপি পদের গেজেট স্থগিত চেয়ে ইলেকশন পিটিশন হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এই ইলেকশন পিটিশনের নিষ্পত্তির আগেই উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে হাইকোর্ট আগামী রোববার থেকে ইলেকশন পিটিশনের ওপর শুনানির দিন ধার্য করেছেন। ইলেকশন পিটিশনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব।
জানা গেছে, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ ও ভোট গণনায় অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এরই মধ্যে আব্দুল হাইকে নির্বাচিত ঘোষণা করে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা। এরপর ইসি তাকে বিজয়ী ঘোষণা করে গেজেট জারি করে। পরে ঝিনাইদহ-১ আসনের এমপি পদের গেজেট স্থগিত চেয়ে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করেন ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নজরুল ইসলাম দুলাল। ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট আব্দুল হাইকে বিজয়ী ঘোষণার গেজেটের কার্যকারিতা স্থগিত করেন।
গত এক ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ দুই মাসের জন্য এই স্থগিতাদেশ দেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রিটার্নিং কর্মকর্তা, ইউএনওসহ ১৭ বিবাদীর প্রতি নোটিশ জারি করেন। নোটিশে কারচুপির অভিযোগে কেন ওই আসনের ফলাফল ঘোষণা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। পরে হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত। এদিকে ইলেকশন পিটন নিষ্পত্তির আগেই আব্দুল হাই মারা যান। ফলে ওই আসনে উপনির্বাচনের ঘোষণা দেয় ইসি। এ আসনে উপনির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ৫ জুন।
জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে থাকেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আব্দুল হাই ও তার সমর্থকরা। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনের ওপর হামলা-নির্যাতন, হুমকি-ধমকি প্রদান, পোস্টার-ব্যানার ছেঁড়াসহ এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তার সমর্থকরা যে কোনোভাবে নৌকার প্রার্থীকে জেতানোর কথাও বলতে থাকেন। এ অবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে বারবারই প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তার সমর্থকরা। গত ১৩ ডিসেম্বর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে চিঠি দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী দুলাল বিশ্বাস। এ ছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগও দাখিল করেন তিনি। এসব অভিযোগের তদন্ত করে একজন বিচারকের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি অভিযোগের সত্যতা পায়।
এরপর নির্বাচন কমিশন আব্দুল হাই ও তার সমর্থকের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা দায়ের করে। ইসি বাদী হয়ে একের পর এক মামলা দায়েরের পরও বেপরোয়া আচরণ ছিল নৌকা প্রার্থী ও তার সমর্থকদের। এ অবস্থার মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন হাকিমপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর কেন্দ্রে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারেন পোলিং অফিসার রাজু আহমেদ। ভোটের দিন দুপুরে ওই কেন্দ্রে গিয়ে সাংবাদিকরা এ চিত্র দেখতে পান। এ সময় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রকাশ্যে সিল মারার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। একই কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায়ও প্রকাশ্যে সিল মারার চিত্র চোখে পড়ে। এর ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে হাইয়ের অনুসারীরা। এ ছাড়া অনেক কেন্দ্রে জোর করে সিল মারার ঘটনা ঘটে। ভোটের দিন নির্বাচন বন্ধ করতে রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর আবেদন জানান স্বতন্ত্র প্রার্থী। কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।
ভোটগ্রহণ শেষে ৭ জানুয়ারি বিকেলে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ঝিনাইদহ-১ আসনে ৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানানো হয়। কাস্টিং ভোটের ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এস এম রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ ছিল। কিন্তু ওই আসনের চূড়ান্ত ফলে ৯ শতাংশ ভোট বেড়ে যায়। ওই আসনে ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ কারণে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭৮ ভোট কাস্টিং দেখানো হয়, যা প্রথম প্রতিবেদনের চেয়ে বেশি ২৮ হাজার ৩৮৯ ভোট। এসব ভোট নৌকা প্রতীকে কাস্টিং দেখানো হয়। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়। এরপর ৮ জানুয়ারি ভোটের ফলের গেজেট স্থগিত রাখতে এবং ১০ জানুয়ারি জারিকৃত গেজেট বাতিলের দাবিতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে নির্বাচনপূর্ব ও পরবর্তী এসব ঘটনা তুলে ধরে হাইকোর্টে ইলেকশন পিটিশন করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নজরুল ইসলাম দুলাল বিশ্বাস।
মন্তব্য করুন