ইসলামী শরিয়তে তালাক হচ্ছে সর্বনিম্ন পর্যায়ের বৈধ কাজ। আমরা মুসলিম হিসেবে দাম্পত্য জীবনের ভাঙন যেন না হয়, সেদিকে পরিপূর্ণ সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।
তালাকের মাধ্যমে যদিও স্বামী ও স্ত্রী মানসিকভাবে সাময়িক স্বস্তি পায়; কিন্তু তাদের যদি কোনো সন্তান থেকে থাকে, তাহলে সেই সন্তান তার মা-বাবার পরশমাখা আদর-স্নেহ সবকিছু হারিয়ে এক ভঙ্গুর মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। যে কোনো যুক্তিসংগত কারণে মুসলিম স্বামী বা স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। তবে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করতে হলে আইন অনুযায়ী কিছু পদ্ধতি মানতে হবে।
আইন অনুযায়ী তালাকের নানা দিক নিয়ে কালবেলা অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলা জজকোর্টের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আইন মেনে কীভাবে একটি তালাক কার্যকর হয়, তার খুঁটিনাটি তথ্য। কালবেলা অনলাইনের পাঠকের জন্য তার চম্বুকাংশ তুলে ধরা হলো।
আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, তালাক সাধারণত একজন আইনজীবী মারফত নোটিশ পাঠানোর মাধ্যমে হতে পারে। কিংবা বিয়ের কাবিননামায় ১৮ নম্বর কলামে যদি স্বামী তার স্ত্রীকে তালাকের অনুমতি না দিয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রী একজন আইনজীবীর মাধ্যমে পারিবারিক আদালতে বিয়েবিচ্ছেদের মোকদ্দমা দায়েরের মাধ্যমে তালাক নিতে পারেন। তালাকের নোটিশ পাঠানোর বেলায় কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। স্বামী ও স্ত্রী সবার ক্ষেত্রেই তালাকের নিয়ম প্রায় এক। দেশে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে আদালত থেকে তালাকের আবেদন করতে পারেন, কিন্তু স্বামীর জন্য তা কিছুটা সীমিত।
মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯-এর অধীনে স্ত্রী ৯টি কারণের যে কোনো এক বা একাধিকের ভিত্তিতে আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের জন্য আবেদন করতে পারবেন। কারণগুলো হলো— ১. স্বামী চার বছরের বেশি সময় নিরুদ্দেশ থাকলে; ২. দুই বছর ধরে স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে; ৩. ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করলে; ৪. সাত বছর বা তার বেশি সময় স্বামী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে; ৫. কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে স্বামী তার দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে; ৬. বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা করার সময় পর্যন্ত স্বামীর পুরুষত্বহীনতা বজায় থাকলে; ৭. স্বামী দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা মারাত্মক যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে;
৮. নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়ে থাকলে অথবা সাবালকত্ব লাভের পর, অর্থাৎ ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর স্ত্রী বিয়ে অস্বীকার করলে (কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকলে এ রকম মামলা করা যাবে না)—
৯. স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করলে, যেমন—স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামীর কোনো অবৈধ সম্পর্ক থাকলে, নৈতিকতাবর্জিত জীবনযাপনের জন্য স্ত্রীকে বাধ্য করলে, স্ত্রীর অমতে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করলে কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির ওপর বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দিলে, স্ত্রীকে তার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া, পবিত্র কোরআনের নির্দেশে একাধিক স্ত্রীদের সঙ্গে সমান ব্যবহার না করলে।
১. তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে। ২. খোলা তালাকের মাধ্যমে তালাক দিতে হবে। শুধু মুখে তিন তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক কার্যকর হয় না। আবার লিখিতভাবে তালাক দিলেও সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হবে না। আইনের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করার পর তালাক কার্যকর হবে। তালাক আইন অনুযায়ী তালাক হবে।
তালাক দেওয়ার অধিকার বা ক্ষমতা স্বামীর সবচেয়ে বেশি। কোনো কারণ ছাড়া স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে।
তালাক দেওয়ার অধিকার বা ক্ষমতা স্ত্রীর কম। আইনে উল্লিখিত কারণ ব্যতীত স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে না। তবে কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামীর মাধ্যমে স্ত্রীকে বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষমতা দেওয়া থাকলে (তালাক-ই-তৌফিজ) স্ত্রী তালাক দিতে পারবে।
ক. খুলা—স্ত্রী তার স্বামীকে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তালাক দেওয়ার জন্য রাজি করাবেন। খ. মুবারত—স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়া।
আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করে তালাক নেওয়া।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বা স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে চাইলে যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাসম্ভব নোটিশ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যানকে পাঠাতে হবে এবং ওই নোটিশের একটি অনুলিপি (নকল) স্ত্রীকে বা স্বামীকে পাঠাতে হবে। একই আইনের ৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নোটিশ দেওয়ার এ বিধান লঙ্ঘন করেন, তবে তিনি এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে স্বামী যদি নোটিশ প্রদান না করে তাহলে শাস্তি পাবে ঠিকই, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না।
৭(৪) ধারা অনুযায়ী, নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন। সালিশি পরিষদ যদি সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয় এবং স্বামী বা স্ত্রী যদি ৯০ দিনের মধ্যে তালাক প্রত্যাহার না করে, তবে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। এই ৯০ দিন স্বামী তার স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে। ৭(৩) ধারামতে, চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ দেওয়ার তারিখ থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। কিন্তু তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী যদি অন্তঃসত্ত্বা থাকে, তাহলে ৭(৫) ধারা অনুযায়ী গর্ভাবস্থা অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ৯০ দিন পর তা কার্যকর হবে।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯৭৪-এর ৬ ধারামতে, বিয়ের তালাক ও রেজিস্ট্রি করতে হয়। কাজী নির্ধারিত ফি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন এবং ফি ছাড়া প্রত্যয়ন কপি দেবেন। এভাবেই তালাক কার্যকর হয়।
মন্তব্য করুন