পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের ‘আলোয়াখোয়া ঠাকুর’ হিন্দু মন্দির জোর করে তালাবদ্ধ করে দেওয়া এবং মন্দিরের মালিকানাধীন দেবোত্তর সম্পত্তি অবৈধ দখলের অভিযোগের ঘটনায় রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর করা আবেদন অবিলম্বে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে গতকাল সোমবার (২৮ আগস্ট) বিচারপতি কে এম কামরুল ও বিচারপতি শওকত আলী চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
নিলফামারী-৩ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য জাতীয়পার্টি মনোনীত মেজর (অবঃ) রানা মোহাম্মদ সোহেলের বিরুদ্ধে ওই মন্দির দখলের অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে গত ১৭ মার্চ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এবং ১৮ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘জমি কেড়ে এমপি রানার চা বাগান’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এছাড়া আলোয়াখোয়া ঠাকুরের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির সদস্য ও পূজারী বিরেন্দ্র নাথ সিংহ মন্দিরের তালা খুলে দিয়ে পূজা অর্চনার সুযোগ দেওয়া এবং মন্দিরের সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত বছরের ৫ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ২১ আগস্ট পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক (ভিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) বরাবর আবেদন করেন। এরপরও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বীরেন্দ্র নাথ সিংহ হাইকোর্টে রিট করেন। যে রিটের ওপর গতকাল শুনানি হয়।
ওই রিটের শুনানি শেষে আদালত রুল জারি করেছেন। রুলে ‘আলোয়াখোয়া ঠাকুর’ মন্দির জোরপূর্বক তালাবদ্ধ করে দেওয়া এবং মন্দিরের মালিকানাধীন দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করাকে কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
চার সপ্তাহের মধ্যে নীলফামারী-৩ আসনের সংসদ সদস্য, স্বরাষ্ট্র সচিব, পঞ্চগড়ের ডিসি, এসপি, আটোয়ারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) আটজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ডিসি-এসপি বরাবর গত ২১ আগস্ট বিরেন্দ্র নাথ সিংহের করা আবেদন অবিলম্বে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী গাজী মো. মহসিন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর একটা সময় চা বাগানের বড় কর্মকর্তা ছিলেন রানা মোহাম্মদ সোহেল। এখন তিনিই পঞ্চগড়ের বিশাল এক চা বাগানের মালিক। বাগানের আয়তন তাও প্রায় ১০০ একর। পঞ্চগড়ে গড়েছেন বিশাল সাম্রাজ্য। কোনো দিন জাতীয় পার্টি না করেই ‘টাকার জোরে’ বাগিয়ে নেন সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন। হয়ে যান নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনের এমপি। তবে এই আইনপ্রণেতার বিত্তশালী হওয়ার পেছনে আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়া নেই!
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনুসন্ধান বলছে, কখনও জবরদস্তি, কখনও আইনের ফাঁদ, মাঝেমধ্যে প্রভাব বিস্তার, আবার কোনো সময় দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে বহু মানুষের জমি দখলে নিয়েছেন তিনি। তার জমি দখলকাণ্ডে বহু মানুষ হারিয়েছেন ভিটা, হারিয়েছেন বসত। ফসলি জমির শেষ সম্বল হারিয়ে রিক্ত হন অনেক চাষী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরের বিপুল জমি এবং দেবোত্তর সম্পত্তিও কবজায় নিয়েছেন তিনি। নানা কৌশলে জায়গা দখল করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে ম্যানেজ করে মন্দিরে তালা দেওয়ারও নজির রয়েছে এমপি রানার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আটোয়ারির আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের বালিয়া মৌজার ১২ একর দেবোত্তর সম্পত্তিও দখল করেছেন এমপি রানা। জমিদার শ্যামা প্রসাদ রায় আলোয়াখোয়া রাশ মন্দিরের জন্য ওই জমি দান করেছিলেন। ওই মন্দিরের সেবায়েত অনিল চন্দ্র রায় ও তার ভাই সুনীল চন্দ্র রায় জমি দেখাশোনা করতেন। মন্দিরের জমি দখল করতে এই দুই ভাইকে ম্যানেজ করে ২০ বছরের জন্য ১২ একর জমি লিজ নেন এমপি রানা। পরে জমি ফেরত দেওয়ার দাবিতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় পঞ্চগড় আদালতে মিসকেস মামলা করে। আদালত মন্দিরের কাছে জমি ফেরত দেওয়ার পক্ষে রায় দেন।
রায়ে বলা হয়, সেবায়েত শুধু মন্দিরের জমি রক্ষণাবেক্ষণের মালিক। এই জমি বিক্রি ও হস্তান্তরযোগ্য নয়। ২০১৩ সালে ওই জমিতে এমপি রানার লোকজন চায়ের চারা রোপণ করতে গেলে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাধা দেন। বর্তমানে এমপির লোকজন সেই জমিতে অন্য ফসল আবাদ করছেন।
স্থানীয়রা জানান, ৭-৮ বছর আগে এমপি রানা স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ম্যানেজ করে ওই মন্দিরে তালা দেন। মন্দিরের ভেতরে প্রতিমাগুলো এখনও আছে।
আলোয়াখোয়ার বিরেন চন্দ্র সিংহ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মন্দিরের জমি মন্দিরের কাজে ব্যবহার হোক। পূজার জন্য মন্দির খুলে দেওয়া হোক। মন্দিরের তালা খোলার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে। তবে কোনো কাজ হয়নি। আমরা সাধারণ মানুষ, ভয়ে মন্দিরের কাছে যেতে পারি না। আমাদের ভয় দেখিয়ে বেআইনিভাবে মন্দিরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা হয়েছে।’
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন ওই সংসদ সদস্য।
মন্তব্য করুন