ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের এজলাসে শুনানি চলাকালে আসামিপক্ষের আইনজীবী স্বপন রায় চৌধুরীকে মারধরের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়ে ঢাকা বারের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, 'গত ৭ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতের ৯ নম্বর এজলাসকক্ষে আমির হোসেন আমুর (আওয়ামী লীগ নেতা) রিমান্ড ও জামিন বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য ছিল। শুনানির সময় দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনায় একজন আইনজীবী মেঝেতে পড়ে যান বলে বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি আদালতের দৃষ্টিতে এসেছে। ন্যায় ও সুষ্ঠু বিচারকার্য প্রতিষ্ঠাসহ আদালতের প্রতি জনগণ ও বিচারপ্রার্থীদের আস্থা সমুন্নত রাখা, আদালতের ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য এজলাসকক্ষে প্রত্যেকের শোভন আচরণ বজায় রাখা একান্ত আবশ্যক। এজলাস চলাকালে আদালতে আইনজীবীদের এমন আচরণ, যা আদালত ও আইনজীবীদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করাসহ জনগণ ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে আদালত ও আইনজীবীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’ ঢাকার সিএমএম আরও বলেন, 'ন্যায় ও সুষ্ঠু বিচারকাজ প্রতিষ্ঠাসহ জনগণ ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে আদালত ও আইনজীবীদের প্রতি আস্থা অর্জনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা জরুরি।' প্রসঙ্গত, গত ৭ নভেম্বর সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর আদালতে রিমান্ড শুনানি জন্য নেওয়া হয়। রিমান্ড চেয়ে পুলিশের আবেদনের পর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বক্তব্য দেন ঢাকা মহানগর ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ভুল বুঝিয়ে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেন। যার ফলে শেখ মুজিব স্বৈরাচার হয়ে ওঠেন এবং বাকশাল গঠন করেন। গণমাধ্যমকে গলাটিপে ধরা সহ রক্ষীবাহিনী গঠন করে ৩৫ হাজার জাসদ নেতা হত্যা করা হয়। যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সুফল ঘরে তুলতে চেয়েছিলো তাঁদেরকে রাজনীতর মাঠ থেকে কোনঠাসা করার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন আমু। একইভাবে শেখ হাসিনাকেও স্বৈরাচার করে তুলতে নিকৃষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। গুম, খুন ,হত্যা, আয়নাঘরের মূল কারিগর আমুরাই। আবার ওয়ান ইলিভেনের সময় তিনিই শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন। চৌদ্দ দলের যেসব নেতা কোন এলাকার ইউপি সদস্য হওয়ার যোগ্য নয় তাঁদেরকে নিয়ে মহাজোটের নামে ভন্ডামি করেছেন আমির হোসেন আমু। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় গণভবনের আলোচিত ৪ আগষ্টের মিটিয়ে তিনি হত্যার পরিকল্পনা করেন ও নির্দেশ দেন। দৈনিক কালবেলা সহ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আমির হোসেন আমুর বিপুল অংকের টাকা লুটপাট, স্বর্নের নৌকা উপহার নেওয়া, টাকার জাজিমে ঘুমানোর খবর প্রকাশিত হয়েছে।' ওয়াদুদ হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে আমির হোসেন আমু সরাসরি জড়িত উল্লেখ করে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ রিমান্ড প্রার্থনা করেন। তাঁর বক্তব্যের পর আমির হোসেন আমুর আইনজীবী দাবি করে স্বপন রায় চৌধুরী বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। এসময় আরেকটি পক্ষে আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন আসামি পক্ষের আইনজীবী দাবি করে শুনানি করতে চান। তবে শাহিনকে কথা বলতে বাঁধা দিয়ে স্বপন পিপি ওমর ফারুক ফারুকীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'দারুণ বক্তব্য রেখেছেন। তবে তা রাজনৈতিক মঞ্চে দিলে ভলো হতো।' সঙ্গে সঙ্গে দুয়োধ্বনি দেন রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটরসহ বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এসময় আইনজীবীদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও ধস্তাধস্তি হলে এক পর্যায়ে স্বপন রায় এজলাস ত্যাগ করেন। এরপর আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন শুনানি এগিয়ে নেন। তিনি বলেন, 'হাইকোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না আমির হোসেন আমির হোসেন আমুর আইনজীবী। আমরা তাঁর সহযোগীতার জন্য এসেছি।' এসময় আসামি পক্ষের আইনজীবীরা দুটি ওকালাতনামা দেন। এনিয়ে পুনরায় হট্টগোলে জড়ান আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এমন পরিস্থিতিতে আদালত আমির হোসেন আমুকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন। আমু বলেন, 'আমি ঢাকা বার ও হাইকোর্ট বারের আজীবন সদস্য। কিন্তু আজ আদালতে যে পরিবেশ দেখলাম তাতে করে আমার কথা বলা উচিত বলে মনে করছি না।' আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমু বলেন, 'আজ যে পরিবেশ দেখছেন আগামীকাল তা থাকবে, এমনটা মনে করবেন না।' এসময় আমুকে দুয়োধ্বনি দেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। পরে আমু আরও যোগ করে বলেন, 'আমি একজন রাজনীতিবিদ আমাকে নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী যে বক্তব্য রেখেছেন তা নিয়ে দুই ঘন্টা বক্তব্য দেওয়া সম্ভব। আমি দুই মিনিটে কী বলবো!' এমন সময় আমুর আইনজীবী দাবি করা স্বপন রায় আদালতের সামনের সড়কের এসে গণমাধ্যমের সামনে দাবি করেন তাকে মারধর করে আদালত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পরে যথারীতি আসামি পক্ষের আইনজীবী পরিচয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। তবে আইনজীবী স্বপন রায় চৌধুরীর দাবি সঠিক নয় বলে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকার মহানগর ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেন, 'আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর আইনজীবীকে মারধর করা হয়নি। বরং তাদের নিজেদের দুটি পক্ষ শুনানি করা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন। এমনকি তারা আদালতে দুটি ওকালাতনামা দিয়েছেন।'
মন্তব্য করুন