আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংস্কার নিয়ে সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবে গণহত্যায় নেতৃত্বের অপরাধে রাজনৈতিক দলকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার মতো বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে আইন বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক মতবিনিময় সভায় আইন বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ধারা সংশোধনের জন্য ৮টি প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী তুলে ধরে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
সভায় ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা বিচার প্রক্রিয়ার খুব কাছাকাছি থাকতে চাই। জুলাই হত্যাকাণ্ডে একটি বৃদ্ধ প্রজন্ম দেশের তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় মেতেছিল।
আমরা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার করতে চাই না, আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই মন্তব্য করে আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের বুকের ভেতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্ষোভ থাক; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অনুষ্ঠিতব্য এই খুনের বিচারকে অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হবে।
অতীতে দেখেছি, বিচারের নামে কী ধরনের অবিচার হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করা।
আসিফ নজরুল আইনের ৮টি সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করার পর তিনি বলেন, এ বিষয়ে মতামত নিতে বিশেষজ্ঞদের কাছে আমরা সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব পাঠাব।
মতবিনিময় সভায় শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, যে কোনো বিচারে প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স টিম থাকে। যেভাবে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়, সেভাবে বিচার করা হবে।
এই বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বিচারক রাখা উচিত উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, আমরা সবাই একমত, ভুক্তভোগীদের সঠিক বিচার পেতেই হবে। আমরা জানি, কী অন্যায় হয়েছে। এখন আমাদের মধ্যে একেবারে নিরপেক্ষ সবকিছু পাওয়া একটু অসম্ভবই বলব। সেই আস্থাটা আনতে একজন অন্তত আন্তর্জাতিক বিচারক বসাতে হবে।
সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব দেখে মনে হয়েছে, আসামিদের ইন্টারেস্ট ও রাইটস প্রটেক্টকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সেখানে আসামিদের পাশাপাশি প্রসিকিউশন যেন বিদেশ থেকে আইনজীবী আনতে পারে, সে রকম বিধান থাকা উচিত।
সবার মতামতের ভিত্তিতে সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব আইনকে এমনভাবে করা হোক, যাতে ভুক্তভোগী এবং আসামি উভয়েই ন্যায়বিচার যেন পায় বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম।
আইনের সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবটি তুলে ধরেন আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আশফাকুর রহমান।
খসড়া সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়।
৮ সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব যা আছে
১ম সংশোধনটি ধারা-৩ সংক্রান্ত। রেড কালারে মার্কড অংশটুকু সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণের অংশ হিসেবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিসংতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম, জোরপূর্বক গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর কারণে জেন্ডার ও কালচারাল গ্রাউন্ডেও যদি কোনো সিভিলিয়ানের ওপর ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণ করা হয় তাহলে তা মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যা পূর্বের আইনে ছিল না।
২য় সংশোধনী ধারা-৩(৩) সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর ফলে গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় বা লায়াবিলিটি নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের ধারা ৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এর এলিমেনটস অব ক্রাইম বিবেচনা করার সুযোগ পাবে।
৩য় সংশোধনী ধারা-৪ (২) সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর ফলে এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্ত্বার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, যা বর্তমান বিধান অনুসারে সম্ভব নয়।
৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যের ভিডিও স্ট্রিমিং বা ওডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিং এর সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সংশোধনীর বুনিয়াদে বিচার কার্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
৫ম সংশোধনী প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে।
৬ষ্ট সংশোধনী- বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ত্বরান্বিত করবে। এ সংশোধনীর অধীনে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
৭ম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় সকল রকম ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ পক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনটির প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ, শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব (চলতি দায়িত্ব) ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আসমা সিদ্দিকা, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব (ড্রাফটিং) মো. রফিকুল হাসান, ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী অফিসের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ড. জাহেদুর রহমান, সাংবাদিক সাঈদ আব্দুল্লাহ, সানজিদা ইসলাম, শরিফ ভূঁইয়া প্রমুখ নিজনিজ মতামত তুলে ধরেন।
মন্তব্য করুন