ঢাকার সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নবী নুর মোড়ল (৫২) নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। নিহতের স্ত্রী আকলিমা বেগম বাদী হয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি করেন। এ মামলার এজাহারভুক্ত ৯৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে জুলহাসকে (৪৬)।
এজাহারে বলা হয়েছে, তিনি ঢাকার সাভার উপজেলার ভাকুর্তা ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। মামলায় জুলহাস মিয়ার বাপের নাম ঠিক থাকলেও গ্রামের নাম উল্লেখ নেই। হত্যা মামলায় নাম আসায় ভাকুর্তা ইউনিয়নের মোগরাকান্দা গ্রামের ছোট ব্যবসায়ী এই জুলহাস মিয়া ও তার পরিবারের এখন দুশ্চিন্তায় রাত কাটছে। এলাকাবাসীর দাবি, জীবনে কোনো দিন রাজনীতি করেননি জুলহাস। দীর্ঘদিন ছিলেন দেশের বাইরে। এখন ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবনযাপন করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। অথচ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাজিয়ে একটি কুচক্রী মহল তার নাম হত্যা মামলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।
মামলার বাদীর দাবি, মামলায় উল্লেখিত আসামিসহ কাদেরকে আসামি করা হয়েছে তা তিনি জানেন না। বাদী আকলিমা বেগমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কালবেলাকে বলেন, ‘আমি বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থানায় যাই। তবে আমি মামলায় একজনেরও নাম দেইনি। আমি তাদের চিনিও না জানিও না। থানায় অনেক লোক ছিল, তারা আমাকে এসে বলে স্বামী হত্যার বিচার চান না? আমি বলেছি চাই। পরে দুটি কপির মধ্যে সিগনেচার করছি। কিন্তু কারা যে এতগুলা নাম দিল, কীভাবে দিল এসব বিষয় আমার অজানা। আমি এতকিছু বুঝি না, আমি শুধু আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’ নিহত নবী নুর মোড়লের গ্রামের বাড়ি খুলনার পাইকগাছা থানাধীন শ্রীকণ্ঠপুর এলাকায়। বর্তমানে তিনি পরিবারের সঙ্গে সাভারের বনপুকুর এলাকায় বাদশা মল্লিকের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করেন।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব, সাবেক পৌরমেয়র আব্দুল গনী, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম সমর, সাভার পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্যানেল মেয়র মো. নজরুল ইসলাম মানিক মোল্লা, আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক হাসান তুহিন, ভাকুর্তা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন ও ভাকুর্তা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাতেনসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার ৯৭ নম্বর আসামি জুলহাস মিয়া বলেন, এমন একটি মামলায় হয়রানির উদ্দেশ্যে আমার নাম দেওয়াটা সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্ভাগ্যজনক। আমি জীবনে কখনোই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। সেখানে ওয়ার্ড কমিটির সহসভাপতির পদ তো অনেক দূরের ব্যাপার। ২০০১ সালে আমি সাউথ আফ্রিকা প্রবাসী হই। সাউথ আফ্রিকাতেও আমি সেখানকার বিএনপির সঙ্গে কাজ করেছি। তবে আমি দেশে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
এছাড়া বিগত আওয়ামী দুঃশাসনে আমি নানাভাবে হয়রানির শিকার হই এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতায় নিয়োজিত ছিলাম। যখন যেভাবে পেরেছি অর্থ সহায়তা এবং খাদ্য সহায়তা দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। এতকিছুর পরও আজ আমি মিথ্যা খুনের মামলা মাথায় নিয়ে অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন, দয়া করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেন এভাবে হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে আপনারা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাকুর্তা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে জুলহাস নামের কেউ নেই। এই মামলায় জুলহাসকে জড়ানোর খবর যে লোকই শুনছেন, তিনিই অবাক হচ্ছেন। সাত নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জাকির হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ করা তো দূরের কথা, জুলহাস ভাই জীবনে কখনো রাজনীতিই করেননি। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আর ধর্ম-কর্ম নিয়ে থাকেন। তাকে অযথা হয়রানির জন্য কুচক্রিমহল মামলায় তার নাম দিয়েছে।’ এ বিষয়ে সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, মামলা করার সময় বাদীর সঙ্গে অনেকেই ছিল। আর বাদী নিজেই এজহারের কপিতে স্বাক্ষর করেছেন, তখন তো তিনি আসামিদের সম্পর্কে জানে না বা চিনে না এমন বিষয় আমাদের জানাননি। তবুও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে না তাদের হয়রানি করা হবে না।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হন। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে তার সরকারের পতন ঘটে। এরপর নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় মামলা দায়ের হচ্ছে। আর এটাকে পুঁজি করে একটি মহল মামলা-বাণিজ্যে নেমে পড়েছে। ঢালাওভাবে সাধারণ নিরীহ মানুষকেও মামলায় আসামি করা হচ্ছে।
এরই অংশ হিসেবে গত ৪ সেপ্টেম্বর সাভার থানায় নবী নুর মোড়ল হত্যা মামলাটি দায়ের হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২০ জুলাই বিকাল ৬টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের যৌক্তিক দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে আন্দোলনে যোগ দিয়ে সাভার বাজার রোড সংলগ্ন ওয়াপদা রোড তিন রাস্তার মোড়ে গেলে মামলার ১ থেকে ১০ নম্বর আসামিদের নির্দেশে ও নেতৃত্বে এবং অপর আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে নবী নুর মোড়লকে হত্যা করে। এতে ঢালাওভাবে ১২৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়।
এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মামলা হওয়ার অর্থ যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। অতি উৎসাহী ও স্বার্থান্বেষী মহল ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে। ওই সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকার যখন বিচারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘকে সত্য অনুসন্ধানে আহ্বান জানিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় কিছু অতি উৎসাহী ও স্বার্থান্বেষী মহল আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এবং প্রতিবাদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোরপূর্বক পদত্যাগ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনি তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ, আদালতে আসামিকে আক্রমণ করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকার সবাইকে আশ্বস্ত করতে চায়, মামলা হওয়ার অর্থ যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন