কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তিচ্ছু সাধারণ শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি–বেসরকারি কলেজ মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ আসন বেশি রয়েছে। শিক্ষার্থীর তুলনায় আসন বেশি থাকায় নতুন প্রতিষ্ঠিত উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আসনসংখ্যক শিক্ষার্থীর ভর্তি শর্ত পূরণে সম্ভাব্য ব্যর্থতায় অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় রয়েছে।
ভর্তি প্রক্রিয়ায় ভারসাম্য এবং নিকটতম সময়ে পিছিয়ে পড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়ন করে এ সংকট উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদরা। তা নাহলে ন্যূনতম ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী নিয়ে পরিচালিত কলেজগুলোয় মানহীন পরিবেশ এবং পাঠদান করে সংকট আরও বাড়বে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৪৬০ আসনের বিপরীতে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮১ জন শিক্ষার্থী আছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজের ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৯৭টি আসন খালি থাকবে। বোর্ডের অধিভুক্ত ৬ জেলার ৪৬১টি কলেজে অনলাইনে ভর্তির আবেদন চলছে। মাদ্রাসা কিংবা অনিয়মিত শিক্ষার্থীরাও যদি এসব কলেজে ভর্তি হয় তাও বিপুলসংখ্যক আসন খালি থেকে যাবে কলেজগুলোতে। যে কারণে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি ও পরীক্ষা উপযোগী করতে না পারলে অনেক প্রতিষ্ঠান সংকটের মুখোমুখি হবে।
এদিকে শিক্ষার্থী সংকটে প্রতিষ্ঠানগুলোর বোর্ড নিবন্ধন কিংবা এমপিও হারানোর শঙ্কাও রয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি কলেজগুলো এই সংকটে বেশি ভুগতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা ।
কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম পাটোয়ারী জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থী টানতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। বিগত পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফলাফল আনতে পেরেছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে যাবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারবে না, তারা পিছিয়ে পড়বে। আর যারা এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে তারা স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারবে না। জহিরুল ইসলাম পাটোয়ারী আরও জানান, স্বীকৃতি নেয়া বা নবায়নের জন্য যে শর্ত আছে সে অনুযায়ী কাম্য শিক্ষার্থী না পেলে যে কোন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বা এমপিও বাতিল হতে পারে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলার ১৬৯টি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে আসন সংখ্যা ৯২ হাজার ৩৫৫। এ বছর এসএসসি পাস করেছে ৫১ হাজার ৩৯ জন। এ জেলায় আসন বেশি আছে ৪১ হাজার ৩১৬টি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৭৫টি কলেজে আসন সংখ্যা ৩৯ হাজার ৭৬৫। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ২০ হাজার ৩২৩ জন। আসন বেশি আছে ১৯ হাজার ৪৪২টি।
চাঁদপুর জেলার ৭০টি কলেজে আসন ৩৮ হাজার ১৬০। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে ২২ হাজার ৬৭৩ জন। এ জেলায় আসন বেশি ১৫ হাজার ৪৮৭।
নোয়াখালী জেলার ৬০টি কলেজে আসন সংখ্যা ৩৯ হাজার ৩৬০। এসএসসি পাস করেছে ২১ হাজার ৯০৪ জন। আসন বেশি ১৭ হাজার ৪৫৬টি।
লক্ষ্মীপুর জেলার ৪৬টি কলেজে আসন সংখ্যা ২৫ হাজার ২২০। এসএসসি পাস করেছে ১২ হাজার ৭৮০ জন। আসন বেশি ১২ হাজার ৪৪০টি। ফেনী জেলার ৪১টি কলেজে আসন সংখ্যা ২২ হাজার ৬০০। এ বছর এসএসসি পাস করেছে ১৩ হাজার ৩৬২ জন। আসন বেশি ৯ হাজার ২৩৮টি।
সরকারি ও বেসরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠান প্রধানদের মতে, মান নিশ্চিত না করে এই শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হারের চেয়ে বেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় সৃষ্টি হয়েছে এই সংকট। সরকারি কলেজগুলো অত্যধিক হারে আসন বৃদ্ধি করায়ও অস্তিত্ব হারানোর সংকটে পড়তে পারে বেসরকারি কলেজগুলো।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ মৃণাল কান্তি গোস্বামী জানান, যখন দেখা যাবে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী যখন কোনো প্রতিষ্ঠান সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে না তখনই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেসব প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। কিংবা কাছাকাছি যদি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকে সেগুলোকে একসঙ্গে করে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন তৈরি হবে।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবির মাসুদ জানান, প্রত্যেকটি সরকারি কলেজে সিট বাড়ানো হচ্ছে। এ কারণে মনে হচ্ছে আসন সংখ্যা বেশি। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু সংকটে পড়বে। যেসব প্রতিষ্ঠান মান ধরে রাখতে পারবে না তারা সংকটাপন্ন হবে এটাই নিশ্চিত। এই সংকট উত্তরণের জন্য নতুন করে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর জামাল নাছের জানান, ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে পিছিয়ে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এক জায়গায় বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে সেগুলোকে একীভূত করা যেতে পারে। না হয় যেসব প্রতিষ্ঠান কাম্য শিক্ষার্থীর ভর্তিশর্ত পূরণ করতে পারবে না তাদের বন্ধ হয়ে যাবে এমপিওসহ নিবন্ধন কিংবা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে আরও সংকট বাড়াবে।
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি কুমিল্লা অজিত গুহ কলেজে অধ্যক্ষ মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, বিগত সময়গুলোতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বোর্ড কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেখানে নির্দিষ্ট দূরত্বসহ এলাকাগুলোর জনসংখ্যার সঠিক অনুপাত রক্ষা করা হয়নি। ফলে আজ কুমিল্লাসহ বোর্ডের অধীন এলাকাগুলোতে নিজ বৈশিষ্ট্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যা শুধু রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাবে সংগঠিত হয়েছে।
কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থীর অভাবের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন বা এমপিওভুক্তি কেটে দেওয়ার মতো এমন কঠোর সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তর নেবে না বলে আমার ধারণা এবং এ ক্ষেত্রে তা মোটেও সঠিক কাজ হবে বলেও আমি মনে করি না। এ সংকট উত্তরণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার্থী ভর্তি শর্তপূরণে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া উচিত।
তাছাড়া তিনি আরও বলেন, আমার জানা মতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন শিক্ষা কারিকুলামে রয়েছে যে, আগামী ২০২৬ সাল থেকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শুধু বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংখ্যা অনুপাতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর সুযোগ থাকবে। তখন কোনো প্রতিষ্ঠান তার ইচ্ছেমতো বোর্ডের একাধিক অনুমতিক্রমে ভর্তির সুযোগ দিয়ে শিক্ষার্থী বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না। দীর্ঘদিন ধরে যা চলমান রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে সরকারি বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে এ সংকট দেখা দেবে না।
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সূত্রে আরও জানা গেছে, একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞানে আসন সংখ্যা ৭২ হাজার ৪৯০। এসএসসিতে বিজ্ঞানে পাস করেছে ৫৭ হাজার ৫১৯ জন। বিজ্ঞানে ১৪ হাজার ৯৭১টি আসন ফাঁকা থাকবে। মানবিকে আসন সংখ্যা ৯৫ হাজার ৯৪০। এসএসসিতে পাস করেছে ৩৯ হাজার ৯৭২। মানবিকে আসন ফাঁকা থাকবে ৫৫ হাজার ৯৬৮টি। ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় আসন ৮৯ হাজার ৩০টি। এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়েছে এ বিভাগে ৪৪ হাজার ৫৯০ জন। আসন ফাঁকা থাকবে ৪৪ হাজার ৪৪০টি।
মন্তব্য করুন