২০২২ সালের পর পুনরায় ২০২৪ সালে বন্যায় তলিয়ে গেছে বৃহত্তর সিলেট। টানা ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের ফলে সমতল আর নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা বন্যায় ভেসে চলেছে। যদিও মাঝে মাঝে ভারি বৃষ্টি না দেখা দিলেও উজানের পানির কারণে দুটি নদীর ৬টি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর ফলে সিলেটের বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থায় অবস্থান করছে। তলিয়ে গেছে বাসা-বাড়ি, গবাদি পশু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাটসহ ক্ষেতের ফসলাদি। বেঁচে থাকার জন্য মানব জীবনের যা যা প্রয়োজন সবই মহা সংকটে দাঁড়িয়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। প্রাণে বাঁচতে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ছুটছে অবিরত।
তবে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ভাটি এলাকায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কিছুটা কমলেও এখনো দুই নদীর ৬টি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাড়িঘরে টিকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ।
জেলা প্রশাসনের হিসাবমতে, সিলেট জেলায় প্রায় ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জেলার ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭৮৬ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পানিতে গোয়াইনঘাটের বিছানাকান্দিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জুয়েল মিয়া নামের এক দর্জির মৃত্যু হয়েছে এবং বুধবার রাত ৮টায় ফতেহপুরের বাংলাবাজার থেকে নৌকা ডুবে বন্যার পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, মাছুদিঘিরপাড়, উপশহর, যতরপুর, সোবাহানিঘাট, মিরাবাজার, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, তোপখানা, বেতেরবাজার এলাকার রাস্তাঘাটে হাঁটু সমান পানি রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, পানি আগের থেকে কিছুটা কমলেও বৃষ্টি শুরু হলে আবার বেড়ে যাবে।
এদিকে সিলেট জেলায় গতকাল বুধবার রাতে কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়নি। উজান থেকে নেমে আসা ঢল অব্যাহত থাকায় জেলার প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ভারতের মেঘালয় ও আসামে এবং বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলাতেও।
চার জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বিভাগে অন্তত ১৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল বুধবার পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কোথাও পানি কমেছে, আবার কোথাও বেড়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য নদ-নদীগুলোর পানি আগের তুলনায় নেমেছে। বন্যার্ত এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।
জৈন্তাপুর এলাকার বাসিন্দা শাহিদ হাতিমি বলেন, আমার উপজেলার কিছু মানুষের বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে। তবে বেশিরভাগ এলাকায় রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে এখনো বন্যার পানি রয়েছে। আমি সিলেট শহরে বাসা নিয়ে থাকি। ঈদের আগেরদিন এলাকায় এসেছিলাম। গিয়ে দেখি আমার বাসার আসবাবপত্রসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিস পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপশহরের বাসিন্দা কাজী জুবায়ের আহমেদ বলেন, ঈদের দিন বাসার নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছিল। পানির জন্য ঠিকমতো ঈদের আনুষ্ঠানিকতা করা হয়নি। বৃহস্পতিবারও বাসায় পানি রয়েছে। বন্দির মতো দিনকাল যাচ্ছে, তবে পানি একটু কমছে।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) বিকেলে ১৩ উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছে সিলেট জেলা প্রশাসন।
জেলার ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭৮৬ জন আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে ওসমানীনগরে ১ লাখ ৮৫ হাজার ও গোয়াইনঘাটে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। জেলার ১৫৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৩০টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত। আর সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ৫৫ হাজার। জেলার উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়ায় সিলেট জেলার সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সকল সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। যার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না।
বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় উদ্ধার বা ত্রাণ সহায়তা যাচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে অনেকের। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ৬০০ টন চাল দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সিলেটে বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টির ওপর বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির বিষয়টি নির্ভর করছে। পাহাড়ি ঢল নামার ফলে নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে বুধবার রাতে কোনো বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়নি। সিলেটে আগামী দুই দিন মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
মন্তব্য করুন