আজ নারায়ণগঞ্জের ভয়াল ১৬ জুন। ২০০১ সালের এই দিনে চাষাঢ়ায় আ.লীগ অফিসে বর্বরোচিত বোমা হামলায় প্রাণ হারায় ২০ জন নেতাকর্মী। ঘটনার দীর্ঘ ২৩ বছর পেরিয়ে গেলেও গত প্রায় ১১ বছর আগে তদন্ত সংস্থা মামলাটির চার্জশিট প্রদান করে। বিচারকার্য চলছে ধীর গতিতে। মামলার নথিতে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ না থাকায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তলব করেছে বিচারিক আদালত।
এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ায়নি কিংবা নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে দলীয়ভাবে তেমনভাবে দিবসটি পালন করা হয়নি আজও। এ নিয়ে হতাশ ও ক্ষুদ্ধ নিহতদের স্বজনরা। নিহতদের পরিবারের দাবি তারা বেঁচে থাকতে এই ঘটনার কারণ জানাসহ দোষীদের বিচার দেখে যেতে চান। সেই সঙ্গে বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে ও দলীয়ভাবে এ দিনটি পালন করার দাবি জানান তারা।
২০০১ সালের ১৬ জুন রাত পৌনে ৯টায় নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিসে শামীম ওসমানের পূর্বনির্ধারিত গণসংযোগ কর্মসূচিতে বর্বরোচিত এ বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। সেদিনের নৃশংস বোমা হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন আ.লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাসহ ২০ জন। তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ আহত হয় অর্ধশত। চন্দনশীল ও রতন দাসসহ অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন সাইদুল হাসান বাপ্পী, আক্তার হোসেন, মোশারফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন ভাষানী, সাইদুর রহমান মোল্লা, নজরুল ইসলাম, স্বপন চন্দ্র দাস, শওকত হোসেন, স্বপন দাস, এনায়েত উল্লাহ, পলি বেগম, হালিমা বেগম, আবদুল আলীম, শুক্কুর আলী, নিধুরাম বিশ্বাস, রাজিয়া বেগম, আবদুস সাত্তার, আবু হানিফ নবী ও অজ্ঞাত এক নারী।
ঘটনার পরদিনই শহর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. খোকন সাহা বাদী হয়ে হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। এরপর চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন।
পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আ.লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে এ মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। দুটি মামলায় ১৪ বছরে ৭ বার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন এবং ৮ম বার ১৩ বছর পর ২০১৩ সালের ২ মে মামলার তদন্ত সংস্থা ৬ জনের নাম উল্লেখ করে সিআইডি আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। বর্তমানে আদালতে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
চার্জশিট ভুক্তদের মধ্যে মুফতি হান্নানকে ২০১৭ সালে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়। মামলার অপর ২ আসামি জমজ সহোদর আনিসুল মোরছালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন ভারতের কারাগারে আটক রয়েছে। ওবায়দুল্লাহ রহমান নামে অপর এক আসামি পলাতক রয়েছেন। আরেক আসামি নাসিকের ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু জামিনে এবং শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল কারাগারে রয়েছেন।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী মহানগর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. খোকন সাহা বলেন, আমার বিশ্বাস আগামী ১৬ জুনের মধ্যে এই সরকারের অধিনে এর বিচারকার্য শেষ হবে এবং আমরা ন্যায় বিচার পাবো। ইতোমধ্যে আদালতে এই মামলার ২১ জনের সাক্ষী হয়েছে।
তিনি বলেন, নিহত কয়েকজনের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নথিতে নাই বিষয়টি আদালতের নজরে আসছে। তাই গত ধার্য তারিখে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে মামলার তৎকালীন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামকে ৫ কার্য দিবসের মধ্যে ব্যাখ্যাসহ হাজির হওয়ার নিদের্শ দেন। কিন্তু তিনি আসেনি, আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাব।
দীর্ঘ ২৩ বছরে বিচার না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বিচার নিয়ে হতাশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি শামীম ওসমান ছাড়া কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকি জেলা ও মহানগর আ.লীগের ব্যানারে দলীয় কোন কর্মসূচি পালন করা হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। তারা দ্রুত নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন এবং আ.লীগের নেতাকর্মীদের তাদের পাশে দাঁড়ানোর দাবি জানান।
বোমা হামলায় নিহত আ.লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন ভাষানীর ছেলে ইমতিয়াজ হোসেন আরান বলেন, আমার বাবাসহ আ.লীগের ২০ জন নেতাকর্মী হত্যার বিচার বিগত ২৩ বছরেও আমরা পাইনি। তার সঙ্গে এটা নিয়ে জেলা ও মহানগর আ.লীগের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি পালন করা হয়নি। তারা তো আ.লীগের নেতারা ছিল তাহলে কেন তাদের নিয়ে গত ২৩ বছরেও কোনো কর্মসূচি পালন করা হলো না। আমরা দাবি জানাই দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক এবং দলীয়ভাবে এই দিবসটি পালন করা হোক।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি অনেক পরিবারেরই একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে অসহায় মাববেতর জীবনযাপন করছে। এই অসহায় পরিবারগুলোর দায়িত্ব সরকারকে বহন করার দাবি জানান পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকা নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চন্দনশীল।
তিনি বলেন, ২০০১ সালের ১৬ জুন এমপি শামীমসহ আ.লীগের নেতাদের হত্যার জন্য হামলা চালানো হয়েছিল। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি শামীম ওসমান ছাড়া আজও জেলা ও মহানগর আ.লীগের কোনো শীর্ষ নেতা পাশে দাঁড়ায়নি। সেই সঙ্গে আমাদের দুঃখ হয় আজও পর্যন্ত দলীয়ভাবে এই দিবসটি পালন করতে দেখেনি। আমরা চাই দলীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হোক। এ ঘটনার বিচারকার্য নিয়ে হতাশ প্রকাশ করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
দুঃখ প্রকাশ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা আ.লীগের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। ১৬ জুন আ.লীগ অফিসে বোমা হামলায় নিহত ও আহতদের স্মরণে অবশ্যই আমাদের জেলা ও মহানগর আ.লীগের কর্মসূচি পালন করা উচিত। ভবিষ্যৎ এ আমরা এ নিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করবো এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াব।
নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাড. মনিরুজ্জামান বুলবুল জানান, বোমা হামলার ঘটনার দায়ের করা দুটি মামলা এখন নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।
এদিকে, দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর সকালে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া শহীদ মিনারের পাশে অবস্থিত স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও দোয়া মাহফিল করেন বিভিন্ন সংগঠন ও নিহতের স্বজনরা। এ ঘটনার মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করে দোষীদের বিচার চায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জবাসী।
আর্কাইভ 
| ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ 
