‘ঘর-দুয়ার উডামু, না কুরমানি দিমু? ঘরডা পইররা গ্যালহে, ধারদেনা আইন্না কোনো রহম খানচাইরে খুডি দিয়া খারা হরছি, ব্যারাহ্যা দেতে পারি নাই। ঘরে চাউল দুগ্গা আছে, ক্ষ্যাতে আবার আডি লাগাইছি চারা কেবল ওটছে। ক্ষ্যাতে এহন কিছু নাই যে বেইচ্যা বাজার করমু। কৃষিবাদা যা দেলহাম সব বইন্যায় ঢইল্লা লইয়া গ্যাছে। আয় ইনকাম বন্ধ, কুরমানি দিমু ক্যামনে? ঈদের দিন একটা ব্রলার মুরহা আইন্না বউ-গুড়াগাড়া লইয়া খামু’। প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনা উপকূলবাসীর ঈদের খোঁজখবর নেওয়ার সময় কথাগুলো কালবেলাকে বলেন সদর উপজেলার ৪নং কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ডৌয়াতলা এলাকার কৃষক আক্কাস মৃধা।
গত ২৬ মে বরগুনাসহ দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। বরগুনা উপকূলে ২৬ মে থেকে ২৭ মে পর্যন্ত প্রায় ১৫ ঘণ্টা যাবত বৃষ্টি, ঝোড়ো বাতাস সঙ্গে সাগর ও নদীতে পানি বৃদ্ধি করাসহ উত্তাল ঢেউ উপকূলে আছড়ে দিয়ে শক্তির দাপট দেখিয়ে গেছে রিমাল। ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল হারিয়ে একপ্রকার অসহায় জীবনযাপন করছেন এ জেলার অধিকাংশ মানুষ।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জেলার আনুমানিক ৩ হাজার ৩৭৪টি ঘর সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হওয়াসহ ১৩ হাজার ৩৪টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরগুনার ৬টি উপজেলার প্রায় তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বেশি ক্ষতি হয়েছে। বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের রামরা ও আয়লা গ্রামের দুই পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও জেলাজুড়ে বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে সড়কে যানবাহন চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টিসহ বেশ কয়েকদিন জেলার বেশিরভাগ গ্রামেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে সরকারি সহায়তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। মাঠে মাঠে আবার বুনতে শুরু করেছে বিভিন্ন ফসলের বীজ। গামছায় চোখের জল মুছে শক্ত করে কোমর বেঁধে রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন প্রায় প্রতিবছর বন্যাকবলিত জেলা বরগুনার মানুষ। এরই মধ্যে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার নিয়ে এসেছে মুসলমানদের কোরবানির ঈদ।
দেশের অন্য জেলাগুলোতে যখন কোরবানির জন্য পশু ক্রয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ঈদের আমেজ ছড়াচ্ছে। তখন বরগুনা জেলার বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ছল ছল চোখে দেখে শুকনো মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। অনেক পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ক্ষেতের ফসল রিমাল নষ্ট করে দিয়ে যেন তাদের ঈদের আনন্দটুকুও ধমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আগের বছরের মতো আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে ছেলে-মেয়ে, ভাইবোন সবাই একসঙ্গে বসে গরু কিংবা ছাগলের মাংস খাওয়া হবে না তাদের, ব্রয়লার মুরগিতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
জেলার বামনা উপজেলার চলা ভাঙ্গা এলাকার জামাল কালবেলাকে বলেন, ‘কুরবানীর জন্য কোথায় ভাগ হবো? গরু কবে কিনবো? ঘরে গেলেই ছেলে মেয়েরা জানতে চায়। ঘূর্ণিঝড়ে এমন অবস্থা হইছে এবার কোরবানি দেওয়ার মতো কোনো কায়দা নাই’।
পাথরঘাটার পদ্মা এলাকার জেলে নাসির কালবেলাকে বলেন, ‘মহাজনের ট্রলারে থাহি। টাহাটোহা লাগলে মাঝে মধ্যে আনতাম। এহন মহাজনেই বিপদে আছে। বইন্নার সময় ঢ্যাফায় পিডাইয়া ট্রলারডারে অ্যাক্কালে নাজুক বানাইয়া হালাইছে। হুনছি এনজিওর লোন উডাইছে, হ্যারপর ধারদেনা আইন্না ট্রলারডার কাম হরায়, কুরবানীও দেবে না আবার। হ্যার দারেও বা কি কমু। ওই আল্লায় যা হরে’।
সদর উপজেলার মোল্লারহোড়া এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী পারুল বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘বইন্নায় ঘরডা হালাইয়া দেলহে। এফির যে টাহা পাডাইছে হ্যাইদ্দা গাছ-খুডি কিন্না ঘরের কাাম ধরছি। কোরবানী দেওয়ার মতো টাহা হাতে নাই। কী কমু শরমের কথা নতুন বেয়াইবাড়ি দাওয়াত দিতে পারি নাই’।
সদরের ফুলঝুরি বাজারের লঞ্চঘাট এলাকার ফিরোজা বেগমের ঘূর্ণিঝড় রিমালে তাণ্ডবে ভাঙা ঘর এখনো সারতে পারেননি। ভাঙা ঘরেই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন এখনও। ঘরের পাশে গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মনে কালবেলাকে বলেন, টাকার অভাবে ভাঙা ঘর এখনো সারাতে পারিনি, কোরবানি দেওবার কথা তো চিন্তাই করতে পারি না। কোরবানি দিনে ছেলে মেয়েদের সামনে যে একটা ব্রয়লার মুরগি কিনে সামনে দেব তার কোনো ব্যবস্থা নাই।
এ ছাড়াও জেলার অন্য উপজেলাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ মানুষ পুনর্বাসিত হতে গিয়ে ঈদের আনন্দ মলিন হয়ে গেছে তাদের।
মন্তব্য করুন