দেশের অন্যতম গরু পালনকারী এলাকা পাবনার বেড়া উপজেলার কৃষক ও খামারিরা কোরবানির পশুর হাটে গিয়ে এবার হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। গত বছরের তুলনায় এবার গরুর দাম কিছুটা বেশি হলেও চড়া দামের গোখাদ্যের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের।
পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় কোরবানির পশুর হাট বলে পরিচিত বেড়া পৌর এলাকার করমজা চতুরহাটে মঙ্গলবার (১১ জুন) ব্যাপক পশুর আমদানি হয়েছিল। প্রতি মঙ্গলবারে এই হাটটি বসে বলে কোরবানি উপলক্ষে গতকালই ছিল শেষ হাট। তবে কর্তৃপক্ষ ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত হাট পরিচালনা করবেন বলে জানিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাটে তিল ধারণের জায়গা নেই। ব্যাপারীরা যেমন গরু তুলেছেন তেমনি প্রচুর কৃষক ও খামারিও বিক্রির জন্য গরু এনেছিলেন। আবার এখানে শুধু স্থানীয় ক্রেতারাই আসেননি, আশপাশের জেলা ও উপজেলাগুলো থেকেও প্রচুর ক্রেতারা এসেছিলেন গরু কিনতে। তবে হাটে গরুর দাম ছিল প্রায় গতবারের মতোই। বেচাকেনাও হয়েছে তুলনামূলক কম। প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় গরু বিক্রি করতে আসা খামারিরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বেড়া উপজেলায় এবার কোরবানির উপযোগী গরুর সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার ৫১৫টি, মহিষ ৬২৩টি এবং ছাগল ৪৪ হাজার ৫৪২টি ও ভেড়া ছয় হাজার ৯৫৯টি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এবার এ উপজেলায় কোরবানির উপযোগী গবাদিপশুর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৬৩৯টি। তবে খামারিদের সংগঠন ও গরু ব্যবসায়ীদের মতে এ উপজেলায় কোরবানির উপযোগী গবাদিপশুর প্রকৃত সংখ্যা কমপক্ষে এক লাখ। এবারের কোরবানির হাটকে সামনে রেখে নিবন্ধিত খামারগুলোর বাইরে উপজেলার অসংখ্য পরিবার গরু-ছাগল পালন করেছে। পরিবারগুলো অল্প দামে ছোট বাছুর কিনে এক থেকে দেড় বছর সেগুলো লালন-পালন করেছে।
খামারি ও গরু ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক বছর ধরে গোখাদের খরচ বাড়তে বাড়তে তা নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর ওপর কোরবানির হাটকে সামনে রেখে এ দাম আরও বাড়ছে। বছর খানেক আগে থেকে ভুষি, কাঁচা ঘাস, খড়, খৈল, চিটাগুড়, ধানের কুড়া, খুদসহ সব ধরনের গোখাদ্যের দাম বাড়ছে। বেশিরভাগ গোখাদ্যের মূল্য আগের তুলনায় দেড় থেকে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ফলে এবার গরু পালনে পালনকারীদের খরচ ব্যাপক বেড়ে গেছে। অথচ কোরবানির হাটে গরু নিয়ে গিয়ে প্রায় গতবারের দামেই গরু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। এতে লোকসান হচ্ছে খামারিদের।
বুধবার (১২ জুন) উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বড় পশুর হাট বলে পরিচিত বেড়া পৌর করমজা চতুরহাটে গিয়ে দেখা যায়, মঙ্গলবার থেকে প্রচুর গরুর আমদানি হয়েছে।
গরুর ব্যাপারী ও হাট কমিটির সদস্যরা জানান, গোখাদ্যের অস্বাভাবিক দামের কারণে এবার খামারিদের গরু পালনের খরচ অনেক বেড়েছে। ফলে হাটে গরু এনে পালনকারীরা বেশি দাম চাইছেন। কিন্তু ক্রেতারা বেশি দামে গরু কিনছে না। ফলে গরু বিক্রি হচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম। তবে এক লাখ টাকার মধ্যের মাঝারি সাইজের গরুর চাহিদা ছিল বেশি। বড় সাইজের গরু বেচাকেনা হয়েছে একেবারেই কম।
বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার আব্দুল মোমিন প্রায় ২০ বছর ধরে কোরবানির হাটকে সামনে রেখে গরুর ব্যবসা করে আসছেন। তিনি জানান, এবার বেড়াসহ আশে পাশের এলাকায় গতবারের চেয়ে গরু পালন হয়েছে বেশি। সেই সঙ্গে গোখাদ্যের অগ্নিমূল্যের কারণে গরু পালনের খরচও অনেক বেড়েছে। তাই কোরবানির হাটে ভালো দাম না পাওয়ায় খামারিদের লোকসান হচ্ছে।
তিনি জানান, গত বছর প্রায় ১০০ গরু কিনে ঢাকার কোরবানির হাটে নিয়ে বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু এবার বাজার অনিশ্চিত ও গোখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় তিনি ১৫ থেকে ২০টি গরু কিনে ঢাকায় পাঠানোর চিন্তা করছেন।
করমজা চতুরহাটে গরু বিক্রির জন্য খামারের ৩৫টি গরু এনেছিলেন সাঁথিয়ার রহিম মোল্লা। তিনি জানান, ‘গত এক বছরে গোখাদ্যের দাম ব্যাপকহারে বেড়েছে। তাই গরু পালনে খরচও অনেক বেড়ে গেছে। এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর পেছনে এক বছরে গোখাদ্য বাবদ অন্তত ২৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। অথচ হাটে আনার পর দেখা যাচ্ছে গত বছরের মতো প্রায় একই দামই বলতেছে। এমন দামে গরু বিক্রি করলে লোকসান হবে। গতকাল ৮টা গরু বিক্রি হয়েছে, অন্যগুলোও বিক্রি হবে ইনশাআল্লা।’ বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, ‘গত বছরগুলোর তুলনায় বেড়ায় এবার কোরবানির পশুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। উপজেলায় এবারের কোরবানির জন্য সব মিলিয়ে ৪৪ হাজার ৬৪৭টি গবাদিপশুর চাহিদা থাকলেও পালন করা হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৩৯টি। অর্থাৎ ৪১ হাজার ৯৯২টি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। সেই পশুগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাবে। চড়া গোখাদ্যের কারণে এবার খামারিদের গবাদিপশু পালনে ব্যয় অনেক বেড়েছে। তাই উপযুক্ত দাম না পেলে খামারিদের লোকসান হবে।’
মন্তব্য করুন