আমজাদ হোসেন শিমুল, রাজশাহী
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪, ১১:৪৮ পিএম
আপডেট : ১২ জুন ২০২৪, ০৩:০০ এএম
অনলাইন সংস্করণ

মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য ‘তিনবার জন্ম’ নেন পপি!

পপি খাতুন। ছবি : সংগৃহীত
পপি খাতুন। ছবি : সংগৃহীত

রাজশাহীর পবা উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পপি খাতুন। তার বয়স মাত্র ২২ বছর। বলা হচ্ছে, দেশের সর্বকনিষ্ঠ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। সর্বকনিষ্ঠ জনপ্রতিনিধির এই তকমা পেতে তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে ‘বয়স জালিয়াতির’। শুধু তাই নয়; নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তাকে জন্মও নিতে হয়েছে ‘তিনবার’। বিষয়টি আশ্চর্যজনক মনে হলেও কালবেলার অনুসন্ধানে তার তিনটি জন্মতারিখ পাওয়া গেছে। তার পুরো নাম মোসা. পপি খাতুন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী দিয়েছিলেন ২০১১ সালে। আর এসএসসি পাস করেছেন ২০১৭ সালে। শিক্ষাগত সনদ ও সর্বশেষ ভোটার তালিকা অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ২২ বছর। বর্তমানে অনার্সে পড়ছেন রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক আর মিউজিক ভিডিও করে বেড়াতেন তিনি।

রাজনৈতিক পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ালেও কোনো পদ-পদবি নেই তার। সে পপিই সবাইকে তাক লাগিয়ে এবার রাজশাহীর পবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও ভোটে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে রহস্যজনক কায়দায় তিনি তার জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) বয়স বাড়িয়েছেন।

তার শিক্ষাগত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, পবা উপজেলার ধর্মহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দেন। ওই সনদে তার জন্মতারিখ ২০০৩ সালের ১২ জানুয়ারি। ২০১৭ সালে স্থানীয় দারুশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেন। এসএসসির কাগজপত্রে জন্মতারিখ রয়েছে ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি। এই জন্মতারিখ সর্বশেষ ভোটার তালিকাতেও রয়েছে। তার ভোটার আইডি নং ৮১০৮১৩০০০১৮৮।

তবে নির্বাচনের আগে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে পপি তার সব সনদে জন্মতারিখ পরিবর্তন করে ১৯৯৮ সালের ১২ জানুয়ারি লেখার আবেদন করেন। গত ২৩ এপ্রিল শিক্ষা বোর্ডের নাম ও বয়স সংশোধন কমিটির সভায় তা পাস হয়। সর্বশেষ সংশোধিত বয়স অনুযায়ী, কাগজে-কলমে তার তিনটি জন্মতারিখ পাওয়া যায়। বয়স বাড়িয়ে ভোটে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছিলেন এমন অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে কালবেলার এই প্রতিবেদক এসব তথ্য উদ্ঘাটন করে।

উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ অনুযায়ী, প্রার্থীর বয়স অন্তত ২৫ বছর পূর্ণ হতে হবে। কিন্তু তার শিক্ষা-সংক্রান্ত কাগজপত্র অনুযায়ী জন্মতারিখ হিসেবে বয়স ২২বছর। ভোটে প্রার্থী হতে গত ২০ মার্চ জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ সংশোধনের আবেদন করেন তিনি। কিন্তু গত ৩ এপ্রিল সংশোধনের আবেদনটি বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে আরেকটি আবেদনও করেন। এরপর গত ২৮ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনে আরেকটি আবেদন করেন। এতে তিনি জন্মতারিখ সংশোধনের আবেদন বহাল রাখার অনুরোধ করেন।

নিয়ম অনুযায়ী জন্মতারিখ সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজের সঙ্গে এসএসসি সনদ সংযুক্ত করতে হয়। তিনি হযরত আলী নামে একজন শিক্ষার্থীর সনদ সংযুক্ত করেছেন। হযরত আলী ২০১৭ সালে নওহাটা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন। তার জন্মতারিখ ২৯ জুন ২০০১। রাজশাহীর সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় তার আবেদন গ্রহণ করে পরদিনই (২৯ এপ্রিল) জাতীয় পরিচয়পত্রটি পরিবর্তন করে দেয়।

নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পেয়েই নির্বাচনের শিডিউলের শেষ দিন ২ মে তিনি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন জমা দেন। গত ২৯ মে পবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। এতে পপি খাতুন ২৪ হাজার ২৭৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। গত ৪ জুন নির্বাচনে পপিসহ বিজয়ীদের নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে। পপি এখন শপথ গ্রহণের অপেক্ষায়।

পবা উপজেলার ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলিমুর রাজি রুবেল বলেন, অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান পপির হঠাৎ উত্থানে আমরা হতবাক! প্রতিবন্ধী ভাতার টাকায় তার সংসার চলে। কিন্তু সে শহরেও বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। তার লাইফস্টাইল ধনীর মতো। টিকটক করে বেড়ায়। উপজেলা নির্বাচনের সময় হঠাৎ শুনতে পাই, পপি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হবেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও আগে জানতেন না তার প্রার্থিতার কথা। নির্বাচনে প্রার্থীর হওয়ার বয়সই হয়নি তার।

হুজরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ভোটের অভিজ্ঞতা রয়েছেন— এমন ব্যক্তিরাই নির্বাচনে প্রার্থী হন। কিন্তু পপির মতো এত ছোট্ট মেয়ে কীভাবে প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলো, বুঝতে পারছি না।

এ বিষয়ে রাজশাহীর সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শাহিনুর আলম প্রামাণিক বলেন, পপি খাতুনের আবেদনের পর তার কাগজপত্র যাচাই করে জন্মতারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে।

এদিকে হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা গেছে, পপি তার জন্মসনদ ডিজিটালাইজড করেন চলতি বছরের ২০ মার্চ। কিন্তু ডিজিটালাইজড করতে যেসব কাগজপত্র দাখিল করেছেন তাতে জাতীয় পরিচয়পত্রও রয়েছে। অথচ পরিচয়পত্রটি ইস্যু হয়েছে ২৪ এপ্রিল। ২৪ এপ্রিল ইস্যু হওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র কীভাবে মার্চেই ইউনিয়ন পরিষদে দাখিল করলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বেলাল হোসেন বলেন, তার জন্মসনদ অনলাইনে ছিল না। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ মার্চ জন্মসনদ অনলাইনে যুক্ত করা হয়।

দারুশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দেওয়া এসএসসি পরীক্ষায় তার ট্যাবুলেশন শিটে জন্মতারিখ ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি আছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা বোর্ডে সাধারণত বয়স কমানোর আবেদন আসে। কিন্তু পপির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী আবেদন আসে। তিনি বয়স বাড়ার আবেদন করেছিলেন। এজন্য রাজনৈতিক চাপও ছিল। পরে কর্তৃপক্ষ তা অনুমোদন দিয়েছে।

তিনটি জন্মতারিখ এবং বয়স নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পপি খাতুন কালবেলাকে বলেন, আমার জন্মতারিখ ভুল ছিল। সব নিয়মকানুন মেনেই জন্মতারিখ পরিবর্তন করেছি। নির্বাচন কমিশন কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই আমাকে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করেছিল। ভোটে আমি বিজয়ীও হয়েছি। একটি মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলেও জানান তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘শেখ হাসিনা আ.লীগকে কবর দিয়েছেন’

স্ত্রীকে শেষ কথা শহীদ জামালের / তুমি বাড়ি যাও, আমি আসছি

ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে কুড়িগ্রাম

বায়ুদূষণের শীর্ষে লাহোর, ঢাকার অবস্থান কত

আ.লীগ নেতা ডন গ্রেপ্তার

আজ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ বন্ধ

আমরা কি মানুষ নই? বৈরুতে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২০

সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন আর নেই

নতুন সিইসি ও কমিশনারদের শপথ দুপুরে

কক্সবাজারে লরির ধাক্কায় ২ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

১০

গ্রিন টি নাকি রং চা, স্বাস্থ্যর জন্য কোনটি ভালো?

১১

নিয়োগ পেয়েই অনুপস্থিত ১১ মাস

১২

যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না আজ

১৩

টিভিতে আজ যেসব খেলা দেখা যাবে

১৪

কেমন থাকবে আজকের আবহাওয়া

১৫

২৪ নভেম্বর : ইতিহাসের আজকের এই দিনে

১৬

যুবলীগ নেতা সম্রাটের সহযোগী মাহিন গ্রেপ্তার

১৭

কুবিতে নৈশপ্রহরী ও কর্মচারীদের শীতবস্ত্র উপহার ছাত্রশিবিরের

১৮

২৪ নভেম্বর: আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

রোববার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

২০
X