টুটন চন্দ্র দাস, মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৪, ০৪:০৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শিক্ষকতা ছেড়ে গারো নারীর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

গারো নারী উদ্যোক্তা চিত্রা নকরেক। ছবি : কালবেলা
গারো নারী উদ্যোক্তা চিত্রা নকরেক। ছবি : কালবেলা

চিত্রা নকরেক অদম্য পরিশ্রমী সফল একজন গারো নারী উদ্যোক্তার নাম। তিনি মধুপুর গড়াঞ্চলের গহিন অরণ্যে ও অবহেলিত পাহাড়ি জনপদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তার আজন্ম স্বপ্ন ছিল পিছিয়ে পড়া অবহেলিত পাহাড়ি নারীদের উন্নয়নে কাজ করে যাবেন। তিনি প্রচণ্ড চড়াই-উতরাই ও বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে সে সোনালি স্বপ্নের ছোঁয়া পেয়েছেন।

আজকের ‘নকরেক ক্রাফট’ তার নিজ হাতে গড়া বাঁশের তৈজসপত্রের এমনি একটি অনন্য সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালার বাহারি রং ও ডিজাইনের বাঁশের তৈজসপত্র এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে দেশে-বিদেশে বিক্রি হচ্ছে এবং সংগ্রহের ঝুলিতে জমা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছানোর জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম, অসীম মনোবল ও অধ্যাবসায়কে পুঁজি করেছেন।

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার পীরগাছা গ্রামের গারো পরিবারের মৃত গুণেন্দ্র স্কু ও মাতা বিনিতা নকরেক দম্পতির মেয়ে চিত্রা নকরেক। তার স্বামী অসীম মৃ একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। দুই সন্তানের জননী চিত্রা নকরেকের বয়স ৩৮ বছর। তিনি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পীরগাছা সেন্ট পৌলস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হন মধুপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সুনামের সঙ্গে এসএসসি, জামালপুর জাহেদা শফির গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন। এখানেই শিক্ষাজীবন শেষ করে বেছে নেন শিক্ষকতা পেশা এবং নিজেকে যুক্ত করেন স্থানীয় সেন্ট পৌলস উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে।

শিক্ষকতা ছেড়ে নকরেক ক্রাফটের যাত্রা যেভাবে

শিক্ষকতার পাশাপাশি চিত্রা নকরেক তার এলাকায় পরিচালিত এক বাঁশের তৈরি তৈজসপত্র কারখানার প্রতি আকৃষ্ট হোন। সেই থেকে নিয়মিত যাতায়াত করতেন তিনি। বাহারি কাজ দেখে ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। হঠাৎ একদিন কারখানার মালিক ব্যবসা গুটিয়ে চট্টগ্রাম চলে যান। এ ঘটনায় কারখানার নিরীহ শ্রমিকগুলো মহাবিপদে পড়ে যান। তখন তারা নিরুপায় হয়ে চিত্রা নকরেককে কারখানা পরিচালনা করার জন্য অনুরোধ জানান। তখন তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে শলাপরামর্শ শেষে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন। গত ২০২০ সালে মাত্র ২ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি ‘নকরেক ক্রাফট’ নামে এ ব্যবসা শুরু করেন।

যে ধরনের তৈজসপত্র পাওয়া যায় এখানে

চিত্রা নকরেক জানান, তার নকরেক ক্রাফট প্রতিষ্ঠানে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত ব্যবহৃত তৈজসপত্র তৈরি হয়। এর মধ্যে পূজা পার্বণে ব্যবহৃত গাছেক বা মদ রাখার থোড়া। কত্থক যা জুম চাষের বীজ বোনার কাজে লাগে ও পানির বোতল রাখা এবং ফুলদানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া বুরাং বা টংঘর, বাজারের ব্যাগ, ভারি লাগেজ।

শৌখিন মানুষের ব্যবহারের জন্য বাঁশের ল্যাম্প, বাজারের ব্যাগ, হ্যান্ডেল ব্যাগ, ফাইল বক্স, ডাস্টবিন শোপিস, বাঁশ ও কাঠের ফুল, ট্রে, হাতপাখা ফুলঝুরি, গারোদের আদি ঐতিহ্যের টং ঘর প্রভৃতি। মেয়েদের ব্যবহারের জন্য কাঠ ও বাঁশের তৈরি চুলের ক্লিপ, খোঁপা, জুয়েলারি বক্স। গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের জন্য কুলা, চালুন, চামচ, খুন্তি ইত্যাদি।

তার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে দামি ফার্নিচার হচ্ছে রাজা বাঁশের তৈরি টি-টেবিল ও সোফাসেট। এই শৌখিন পণ্য ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

উপকরণ

এসব তৈজসপত্র তৈরির কাজে টলা বাঁশ, সুন্দরী বাঁশ, তারাই বাঁশ ও বেতের প্রয়োজন হয়। এসব তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। বাঁশ-বেত সংগ্রহ ও কাটাকাটির কঠিন কাজ তিনি পুরুষ শ্রমিক দিয়ে করিয়ে থাকেন।

এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক সংখ্যা মোট ২০। তার মধ্যে ১৫ জনই নারী ও বাকি ৫ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর হতদরিদ্র মানুষ। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসে কাজের বেশি চাহিদা থাকে। এ সময় শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০। শ্রমিকদের মাসিক গড় বেতন ১২ হাজার টাকা। কেউ কেউ প্রোডাকশনে কাজ করে মাসে গড়ে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান। নারী শ্রমিকরা নিজ বাড়িতে বসে কাজ করে থাকেন। কাজ শেষে পীরগাছা বাজারের ’নকরেক ক্রাফট’ শোরুমে পৌঁছে দেন তারা।

চিত্রা নকরেক জানান, আমার ‘নকরেক ক্রাফট’ এর তৈজসপত্র পাহাড়ি মানুষগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করে। তা ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, শ্রীমঙ্গল ও ঘাটাইল সালাহউদ্দিন সেনাবাহিনীর বাসে নিয়মিত বিক্রি হয়। তা ছাড়া বছরে দুবার কেয়া কসমেটিকস-এর সৌজন্যে ’হিজল তমাল’ রেস্টুরেন্টে মেলার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে শৌখিন মানুষগুলো আমাদের পণ্যগুলো কিনে নেন। তা ছাড়া দেশের সুনামধন্য সুপারশপের মালিকরা তাদের পণ্য নিয়মিত কিনে নেন ও অর্ডার দিয়ে থাকেন। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী এসব পণ্য সুনামের সঙ্গে আমরা সরবরাহ করে আসছি। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা ও দামও ভালো। ভালো দাম পেয়ে আমরা অনেক খুশি।

এ শিল্পের প্রধান ও জাতীয় সমস্যা হলো প্লাস্টিক ও পলিথিনের তৈরি পণ্যসামগ্রী। এসব পণ্যের কারণে ব্যাপকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং দেশীয় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।

নকরেক ক্রাফটসে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ কেনাকাটা করে থাকেন। তেমনি একজন সাংবাদিক স্বাধীন আজম। তিনি জানান, এর আগেও এখানে স্ব পরিবারে কেনা কাটা করতে এসেছেন। আজ এসেছেন ফুলদানি ও শোপিচ কিনতে। দাম সুলভ মূল্যে রয়েছে বলে তিনি জানান।

অপার সম্ভাবনাময় বাঁশের তৈরি তৈজসপত্র শতভাগ পরিবেশবান্ধব। দেশি-বিদেশি বাজারে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা ও অসীম সম্ভাবনা। চিত্রা নকরেক অবহেলিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীর জীবনমানের বৈচিত্র্য এনেছে। আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা সমৃদ্ধ করেছে তার এ বাঁশের শিল্পকর্ম।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শরীরের সবচেয়ে নোংরা অংশ কোনটি, জানলে অবাক হবেন

ব্রাজিলে বাস খাদে পড়ে নিহত ২৩

ঢাকায় ট্রেনের ৩ বগি লাইনচ্যুত

মেঘে ঢেকেছে ঢাকার আকাশ, বৃষ্টি হবে কবে?

উত্তরে হঠাৎ তীব্র শীত

আজ ঢাকার বাতাস ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’

অকেজো হওয়ার পথে শিক্ষার্থী তামিমের হাত

ফিলিস্তিনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ ইহুদি

শসা খেলে কি আসলেই ওজন কমে? 

পাবনায় চরমপন্থি দলের সাবেক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

১০

লেবানন থেকে ইসরায়েলে শত শত রকেট হামলা

১১

জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থায় চাকরি, আবেদন শেষ তারিখ ১ ডিসেম্বর

১২

টিভিতে আজ যেসব খেলা দেখা যাবে

১৩

২৫ নভেম্বর: আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

সোমবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

১৫

২৫ নভেম্বর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

মেঘনা গ্রুপে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির সুযোগ

১৭

ইবিতে বিভাগের নাম পরিবর্তনের দাবিতে প্রধান ফটক অবরোধ

১৮

যবিপ্রবিতে বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে রিসার্চ সেলের সেমিনার

১৯

ইবিতে চুরির অভিযোগে আটক ২

২০
X