ঘূর্ণিঝড় রিমালে দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় উপজেলা পিরোজপুরের কাউখালীতে, মুরগির খামার, গবাদিপশু, মৎস্য ও কৃষি খাতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, মৎস্যজীবী,খামারি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উদ্যোক্তা বিভিন্ন দপ্তরে, জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা নিয়ে ধরনা দিচ্ছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি ঋণ প্রকল্প গ্রহণসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাউখালী উপজেলার তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় রিমালে সবচেয়ে বেশি কৃষিখাতে প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার সহস্রাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১৭২৮ হেক্টর ফসলি জমির উৎপাদিত ফসল নষ্ট হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোমা রানী দাস জানান, আউশের বীজতলা, আউশ ক্ষেত, চীনা বাদাম, মরিচ, মুগ ডাল, তিল, শাকসবজি, ভুট্টা, পান, কলা, পেঁপে ও ফল ফসলের বেশি ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির ধকল পুষিয়ে উঠতে চাষিদের সময় লাগবে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বীজতলা বা ফসলের ক্ষেত চাষ উপযোগী হতেও কয়েকদিন সময় লাগবে। বিলম্বে চাষ উপযোগী হলে সেটিও কৃষকের জন্য ক্ষতির কারণ। যে কারণে প্রান্তিক চাষিদের চাহিদার ওপর নির্ভর করে বেশকিছু প্রস্তাবনা করা হচ্ছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করছেন।
ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে কাউখালী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূল্যের গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল মৃত ও ভেসে গেছে। উপজেলায় ৫টি ইউনিয়নে পাঁচ শতাধিক মুরগি ও হাঁস খামারের প্রায় ১৫ হাজার মুরগি পানিতে ডুবে মারা গেছে। অন্যদিকে ছোট, বড় খামারীদের শতাধিক ছাগল ও কয়েকটি গরু মারা গেছে। যার আনুমানিক মূল্য ৪০ লাখ টাকা।
উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শিশির কুমার রায় জানান, মাঠপর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা করা হচ্ছে এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে মৎস্য চাষিদের ২০০টি পুকুর ও ৭৫টি মাছের ঘেরের মাছ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে উপজেলার সহস্রাধিক বড় ও ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে মৎস্য খাতে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, মাছচাষি ও মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ ঝড়ের স্থায়িত্ব, জলোচ্ছ্বাস ও বাতাসের প্রবলগতি। যারা ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের তালিকা করে প্রান্তিক জেলে ও মৎস্য চাষিদের প্রত্যাশা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কাজ চলমান রয়েছে।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রশিদ মিলটন জানান, তার ঘেরে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কয়েক শতাধিক মুরগি, গবাদিপশু, ঘেরের মাছ, কলাবাগান, বাগানবাড়ি ফসলি জমি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে।
উপজেলার চিড়াপাড়া ইউনিয়নের মুরগির খামারি আব্দুর রশিদ ও ফজলুল হকের দুটি খামারের তিন হাজার মুরগি পানিতে ডুবে মারা গেছে। তিনি জানান, আমরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। সরকার থেকে সহায়তা না পেলে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। দক্ষিণ নিলতি গ্রামের মো. ফোরকান হোসেন জানান, এক হাজার মুরগি ভেসে গেছে।
রিমালের কারণে অতিবৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় গোটা উপজেলা শহর। যেসব জায়গায় বিগতদিনে পানি জমেনি, এবার সেসব স্থানেও কোমরসমান পানির নিচে ছিল। এই পানির কারণেই দক্ষিণ বাজার ও উত্তর বাজার ব্যবসায়ীদের গোডাউন, চাউলপট্টি এলাকার অন্তত ৩৫টি আড়তের কয়েকশ’ টন চাল ভিজে গেছে। পানিতে ভেজা চালের মধ্যে মিনিকেট, পাইজাম, স্বর্ণা, বুলেট, আটাশ, চিনিগুঁড়াসহ বিভিন্ন প্রকারের চাল রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ভিজে যাওয়া চাল মানুষের খাওয়ার কোনো উপায় নেই। দু-একদিনের মধ্যে মাছের খাবার হিসেবে চালগুলো কেউ নিতে পারে। এসব চালের মূল্য প্রায় কোটি টাকা। পানি নেমে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে বিভিন্ন জায়গায় চালগুলো শুকানোর চেষ্টা করছেন। তবে তাতে ২০ শতাংশ চালও উদ্ধার হয় কিনা সন্দেহ রয়েছে। পাশাপাশি সিমেন্ট, চালের সঙ্গে সঙ্গে আটা, চিনি, ডাল ময়দাসহ অনেক ব্যবসায়ীর মুদি-মনোহরীর মালামাল পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। সব ব্যবসায়ীর মিলিয়ে প্রায় ১০০ টনের মতো চাল ভিজে গেছে।
দক্ষিণ বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাঈদ জানান, তার ৩০০ ব্যাগ সিমেন্ট পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে এবং প্রায় ১০০ বস্তা চাল নষ্ট হয়েছে।
ইউএনও সজল মোল্লা জানান, বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে এবং আমি উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে যাচ্ছি।
কাউখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মিয়া মনু উপজেলার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ প্রদান করেন।
এদিকে ৩১ মে শুক্রবার পিরোজপুর দুই আসনের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
মন্তব্য করুন