খুলনার পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের লিটু সরদার। রিমালে ভেসে গেছে ঘরের অধিকাংশ জিনিসপত্র। ঘরের মধ্যে এখনো জোয়ারের পানি। পানিতে থৈথৈ করছে ঘরসহ পুরোগ্রামে। চারদিকে এত পানিতে সারা দিন শরীর ভেজা থাকলেও কোথাও এতটুকু খাবার পানি নেই। অনেক দূর হেঁটে গিয়ে রাস্তার ওপর মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান থেকে খাবার পানি আনতে হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা অত্যন্ত অপ্রতুল।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে খুলনার উপকূলের চারদিক পানি আর পানি। থাকলেও কোথাও একফোঁটা খাবার পানি নেই। উচ্চ জলোচ্ছ্বাসে মিঠা পানির সব আধারগুলোতেই ঢুকে পড়েছে লবণ। শুধু লিটু সরদার বা তার স্ত্রী কল্যাণী সরদার নয় এই চিত্র খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৩টি গ্রাম পুরো উপকূলবাসীর।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২২নং পোল্ডারের আওতাধীন এই ১৩টি গ্রাম রিমালে সর্বোচ্চ ক্ষতির জনপদগুলোর একটি। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি না থাকায় গ্রামগুলোর মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভদ্রা নদীর বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৩ গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ এখন দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভাসছে। বুধবার পর্যন্ত স্থানীয়রা একাধিকবার রিং বাঁধ নির্মাণের একাধিক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালালেও বারবার জোয়ারের পানি নির্মাণাধীন বাঁধ ভেঙে নতুন করে আবার প্লাবিত করছে গ্রাম। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বাঁধ নির্মাণকাজ। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গ্রামবাসী। শুধু পাইকগাছার ১৩টি গ্রাম নয়- দাকোপ, কয়রাসহ খুলনা উপকূলের ৬৮টি ইউনিয়নের অবস্থা প্রায় একই রকম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলাসহ সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর ও বাগেরহাটের শরণখোলায় ৬৮টি ইউনিয়ন এবং দুটি পৌরসভায় লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। পরিপূর্ণ বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় রিমালের চারদিন পরেও এখনো জোয়ারের পানিতে ভেসে যাচ্ছে সব কিছু। বৃহস্পতিবার আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের দশালিয়া গ্রামটি। এই গ্রামের ১৫ হাজার মানুষের খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে। শরণখোলার রায়েন্দাতে কয়েকটি গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা এবং সুতারখালি ইউনিয়নের মানুষের খাবার পানির আধার নষ্ট করেছে রিমাল। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে যে ট্যাংক এ রাখা হতো বেশিরভাগ ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অবশিষ্ট পানি নষ্ট হয়েছে। সুতারখালি চেয়ারম্যানবাড়ি পুকুরসহ মিঠা পানির আধার কয়েকটি পুকুর থাকলেও রিমালে সবগুলো পুকুরের পানি এখন লবণাক্ত। ফলে এসব এলাকার মানুষের খাবার পানির জন্য হাহাকার চলছে।
এ ছাড়া সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা গ্রাম। জন্মই আজন্ম পাপ এই এলাকার মানুষের। আইলার আঘাতের ১৫ বছরে গ্রামের কেউ এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আবারও রিমালের আঘাতে লন্ডভন্ড এই গ্রাম। এখানে বাঁধ উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে খাবার পানি নেই গ্রামের কোথাও। অগভীর নলকূপের নোনাপানি বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে এই গ্রামের মানুষের। ননী রানী মণ্ডল এই পানি নিয়ে যাচ্ছিলেন। পানি পেলেন কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, লবণ-পানি এটা টিউবওয়েল থেকে নিয়েছি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকমল হোসেন কালবেলাকে বলেন, খুলনায় বেশ কয়েকটি গ্রামে বিশুদ্ধ পানির আধার কিছু পুকুর যা সরকারিভাবে খনন করা হয়েছিল। মানুষ এখান থেকে পানি খেত। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে এখান থেকে মানুষ আর পানি খেতে পারছে না।
তিনি বলেন, বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরাও বেশ কয়েকটি জায়গা পাইকগাছার দেলুটি, দাকোপের বটবুনিয়া বাজার, পানখালির খালসিতে মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট পালনের মাধ্যমে স্থানীয়দের মাঝে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করে আসতেছি। এ ছাড়া পানিবন্দি এলাকাগুলোতে যেমন কয়রার দশালিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেওয়া হচ্ছে। এখন সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মানুষের পানির কষ্ট আর থাকবে না আশা করি।
মন্তব্য করুন