রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা তীরবর্তী চরাঞ্চলের মজলিশপুর, দেবীপুর, চর দৌলতদিয়া ও আংকের শেখেরপাড়া গ্রাম এলাকায় কৃষি ক্ষেতে ভয়ংকর বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত) এর উপদ্রব বেড়েছে।
গত দেড় মাসে সেখানে এই সাপের কামড়ে মারা গেছে সাঈদুল শেখ নামের এক কৃষক ও ময়না বেগম নামের এক শ্রমিক। এতে এলাকার কৃষকরা ভয়ে ক্ষেত পরিচর্যা, সেচ ও সার দিতে পারছেন না। ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতেও সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। অন্যদিকে আতঙ্কিত না হয়ে ক্ষেতে কাজ করার সময় সাপ থেকে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, গত ৮ এপ্রিল গোয়ালন্দের চর মজলিশপুর এলাকায় ভুট্টা ক্ষেত পরিচর্যাকালে সাঈদুল শেখ নামের এক কৃষককে সাপে কামড়ায়। ওই দিনই তাকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সাপে কামড়ানোর সাত দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে মারা যান কৃষক সাঈদুল।
এর আগে গত ২৯ মার্চ গোয়ালন্দের দেবীপুর চরে ময়না বেগম নামের এক শ্রমিককে সাপে কামড়ানোর পর ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের ১৪ দিন পর নিজ বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। এ দুটি ঘটনায় মৃতদের রাসেল ভাইপার সাপে কেটেছে বলে স্থানীয়রা জানায়।
দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ছোরাপ মণ্ডলপাড়া গ্রামের কৃষক মো. জুলহাস বেপারী বলেন, উজানচর ইউনিয়নের দেবীপুর চরে আমার নিজস্ব জমি আছে। গত কয়েক দিনে আমার ওই কৃষিক্ষেত থেকে তিনটি রাসেল ভাইপার সাপ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। প্রতিটি সাপ দুই থেকে আড়াই হাত লম্বা ছিল।
মজলিশপুর চর এলাকার বাসিন্দা কৃষক আলমাস শেখ বলেন, কৃষিক্ষেতে সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় আমরা ভয়ের মধ্যে আছি। ক্ষেতের পরিচর্যা কাজের জন্য শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয় উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. গোলজার হোসেন মৃধা বলেন, মজলিশপুর, দেবীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন চর এলাকায় কৃষিক্ষেতে সাপের উপদ্রবের কথা আমি জেনেছি।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. খোকনউজ্জামান বলেন, উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় কৃষিক্ষেতে সাপের উপদ্রব বেড়েছে। মেরে ফেলা কয়েকটি সাপের ছবি দেখে বোঝা গেছে ওই সাপগুলো রাসেল ভাইপার।
এদিকে রাসেল ভাইপার সম্পর্কে তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক এবং বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলা জানান, রাসেলস ভাইপার (Russell's Viper) সাপটি ‘চন্দ্রবোড়া’ বা ‘উলুবোড়া’ নামেও পরিচিত। আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। এটি ইঁদুর ও টিকিটিকি খায়। ফসলের ক্ষেত ও বসতবাড়ির আশেপাশে প্রাণীদুটির প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেলস ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কখনও কখনও আক্রমণও করে।
জোহরা মিলা বলেন, পদ্মার চরাঞ্চল, নদী অববাহিকা ও বরেন্দ্র এলাকায় উঁচু-নিচু ঘাস বা ফসলের জমিতে এই সাপটি বেশি দেখা যায়। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে এর প্রজননকাল। সাপটি ডিম দেওয়ার বদলে সরাসরি ৬-৬৩টি বাচ্চা প্রসব করে। দেখতে মোটা, লম্বায় ২ থেকে ৩ ফুট দৈর্ঘ বিশিষ্ট এই সাপের গায়ে ছোপ-ছোপ গোলাকার কালো দাগ থাকে। ঘন ঘন জিহ্বা বের করে হিসহিস শব্দ করে। সাপটি সম্পর্কে যার ধারণা নেই তিনি এটিকে অজগর ভেবেই ভুল করবেন।
জোহরা মিলা বলেন, এই সাপের বিষ ‘হেমোটক্সিন’ হওয়ায় মাংস পঁচেই আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী সাপটি সংরক্ষিত।
এটি দুর্লভ প্রজাতির একটি সাপ। পূর্বে শুধু বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ পাওয়া গেলেও বর্তমানে এরা পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলা ও চরগুলোতেও বিস্তার লাভ করেছে।
মন্তব্য করুন