দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের বহুল উৎপাদিত ফল চকোলেট তৈরির কাঁচামাল ‘কোকোয়া’ চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশেও। প্রতি বছর বিদেশ থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ‘কোকোয়া’ আমদানি করা হয়। ফলে দেশে উৎপাদন ছড়িয়ে দিতে পারলে এ অর্থ বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে সাধারণত ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ‘কোকোয়া’ আমদানি করা হয়। তবে দেশেও এর চাষের উপযোগিতা পরীক্ষার জন্য ২০১৪ সালে ভিয়েতনাম থেকে গবেষণার জন্য বাংলাদেশে বেশ কিছু ‘কোকোয়া’ ফলের চারা আনা হয়। বর্তমানে পরিণত হয়ে ফল দিচ্ছে। পরিপক্ব ফল তুলে একদিকে যেমন খাওয়া যাচ্ছে, আবার প্রক্রিয়া করে তৈরি করা হচ্ছে চারাগাছও।
ঢাকার অদূরে সাভারের হর্টিকালচার সেন্টারে ‘কোকোয়া’ ফলের দুটি গাছ রোপণ করা হয়েছিল। সেগুলো পরিপক্ব হয়ে এখন ফল দিচ্ছে।
হর্টিকালচার সেন্টার সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে এই ফলের চারা এনে রোপণ করা হয়। সাভারে দুটি গাছ রয়েছে। প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর ধরে গাছে ফুল ও ফল ধরছে।
হর্টিকালচার সেন্টারের উপসহকারী উদ্যান কর্মকর্তা দিলীপ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘কোকোয়া ফলের ভেতরে থাকা বীজ থেকে এটির চারা উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়া কলমের মাধ্যমেও চারা উৎপাদন করা যায়। চারা রোপণের ৫ থেকে ৬ বছর পর থেকে ফল ধরা শুরু করে। বছরে ৩ থেকে ৪ বার ফলন হয়। ফলে সারা বছরই কমবেশি ফল পাওয়া যায়। এ ফলের গাছে তেমন কোনো রোগ হয় না বললেই চলে। দেশীয় ছাত্রাপোকা (মিলিবাগ) হলেও সেটি আপনা-আপনি প্রতিরোধ করে ফেলে।’
তিনি বলেন, ‘ফুল থেকে ফল হয়ে সেটি পাকতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ মাস। পাকার পর কোনোটা ধূসর কোনোটা হলুদ রং ধারণ করে। ভেতরে ফল থাকে। খোসা ছাড়িয়ে ফল বের করতে হয়। পাকা ফল খাওয়া যায়। স্বাদ টক মিষ্টি। আবার ফল বের করে সেটিকে প্রক্রিয়াজাত করে চকোলেটের পাউডার তৈরির জন্য প্রস্তুত করা যায়।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ফলের রং বাদামি, ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ১০ সেন্টিমিটার পুরু, বাইরের আবরণ চামড়ার মতো শক্ত। প্রতিটি ফলে ২০ থেকে ৪০টিরও বেশি বীজ থাকে। বীজগুলো প্রথমে কলাপাতায় মুড়িয়ে গাজানো হয়। পরে রোদে শুকিয়ে সেদ্ধ করে খোসা ছাড়ালেই পরিষ্কার একটি শাঁস পাওয়া যায়। এই শাঁসকে বলা হয় কোকোবিন। কোকোবিনের গুঁড়োই চকোলেট পণ্য তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। উৎকৃষ্ট মানের চকোলেট, মাখন, আইসক্রিম, রুটি, পুডিং, প্রসাধনসামগ্রী ও পানীয় তৈরিতে কোকো ফল ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ণবয়স্ক একটি ‘কোকোয়া’ গাছ থেকে ৩৫ কেজি ফল পাওয়া যায়। প্রক্রিয়াজাত করলে সেখান থেকে ৩০ কেজি চকোলেট পাউডার পাওয়া যাবে। প্রতি কেজি চকোলেট পাউডারের দাম বর্তমানে প্রায় ৪০ ডলার। ওই হিসেবে একটি গাছ থেকে বছরে এক হাজার ডলারের বেশি আয় করা সম্ভব।’
সাভারের রাজালাখের হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. জামিউল ইসলাম বলেন, ‘চারা বেড়ে ওঠার জন্য এসিডিক বা অম্লীয় মাটির প্রয়োজন হয়। সাভারের যে লাল মাটি সেটি এই গাছের চারা বেড়ে ওঠার উপযোগী। আমাদের এখানে গাছগুলো বেড়ে উঠেছে। এখন ফল দিচ্ছে। একইভাবে দেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মাটিও উপযোগী। ছাদবাগানেও কোকো ফল চাষ করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে অন্তত ৫ থেকে ৭ লাখ হেক্টর অনাবাদী জমি রয়েছে। যেখানে এই গাছ চাষের উপযোগী মাটি রয়েছে। ভিটামিন এ বি সি ই ও কে সমৃদ্ধ এই ফলের চকোলেট পাউডার শতভাগ বাংলাদেশকে বিদেশ থেকে আনতে হয়। দেশে এটির উৎপাদন বাড়লে আয়ের বড় পথ উন্মোচন হতে পারে।’
এই ফলের চাষ বৃদ্ধিতে সরকারি উদ্যোগ রয়েছে কি না প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চারা উৎপাদন করছি। সেগুলো নামমাত্র মূল্যে ও বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। অনেকেই এটি চাষ করছেন। উৎসাহিত হচ্ছেন চাষে। এটির আরও প্রসারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়া রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সবাই আন্তরিক।’
মন্তব্য করুন