আজ ৯ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াবাসীর জন্য এক শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গজারিয়ার মেঘনার শাখা নদী ফুলদী তীরের গোসাইরচর, নয়ানগর, বালুরচর, বাঁশগাঁও জেলেপাড়া, ফুলদী, নাগের চর, কলসেরকান্দি, দড়িকান্দি, ইসমানিরচর ও গজারিয়া এই ১০ গ্রামে ৩৬০ জন নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এই গণহত্যায় ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়।
গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা লোকজনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মধ্য এপ্রিলের ঘটনা। আব্দুল খালেক আলো নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক যুবক গোসাইচর গ্রামে ‘আলোর দিশারী’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুলে উপজেলার প্রায় ২০০ তরুণকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তোলেন। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে এই ট্রেনিং ক্যাম্পের খবর পেয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী।
৯ মে নীরব-নিস্তব্ধ রাতের মৌনতা শেষে ভোরের সূর্য ওঠার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার ও কামানের আওয়াজ এলাকাবাসীকে আতঙ্কিত করে তোলে। ফুলদী নদী দিয়ে স্পিডবোটে গজারিয়ার ভবেরচর ইউনিয়নের ১০টি গ্রামে হানা দেয় তারা। রাজাকাররাই তাদের পথ দেখিয়ে গজারিয়া নিয়ে এসেছিল। সেদিন সকাল ৬টার মধ্যেই সোনালি মার্কেট এলাকায় রাস্তার ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, কৃষক, মুক্তিযোদ্ধাসহ ১১০ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রান্ত গ্রামগুলোকে থেকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয় মোট ৩৬০ জনকে। সেদিন কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা আর পুরনো কাপড় পেঁচিয়ে নিহত স্বজনদের ১০টি গণকবরে দাফন করেছিলেন গ্রামবাসী।
তবে পাকিস্তানি বাহিনী ওই দিন শুধু নিরীহ নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি। সমানতালে ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ গ্রামবাসীদের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন।
গজারিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল খালেক আলো সেদিনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে দেশকে রক্ষার স্বপ্ন গ্রামের বাড়ি গজারিয়া সদরের গোসারচরে চলে যাই। পরে ত্রিপুরা গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রামে ফিরে ‘আলোর দিশারী’ নামে একটি স্কুল গড়ে তুলি যেখানে ২০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরইমধ্যে খোকা চৌধুরী, শামস চৌধুরী, গফুর চৌধুরী, মোজাফফর আলীসহ আরও কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার খবর পাকিস্তানি ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ৯ মে আমাদের গ্রামে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা, খুঁজতে থাকে আমাকে।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, হামলায় গজারিয়া, নয়ানগর এবং গোসাইরচর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই এলাকাগুলোর প্রতিটি বাড়িতেই সেদিন অন্তত একজনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই রাতে বাশগাঁও, সোনাইরকান্দি, নাগেরচর, ফুলদী, কালিয়াপুর ও বেলতলীর মতো এলাকায়ও হামলা হয়।
তিনি বলেন, ওই হামলায় আমি আমার ছোট ভাই মোয়াজ্জেমকে হারিয়েছি...আমার পাঁচ চাচাতো ভাই ও চাচা সেই হামলায় মারা গেছে। এছাড়াও, প্রায় ১০ জন প্রতিবেশী, যারা আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল, তাদেরও হত্যা করা হয়।
এ সময় আমার মা একটি কথাই বললেন, ‘তুই যুদ্ধে চলে যা। যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। প্রয়োজন হলে আমিও যুদ্ধে যাব’। এরপর ১১ মে আমি গ্রামের অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেই। এক সময় আমাকে গজারিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার করা হয়।
আলো বলেন, ১৪ আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, তাই চূড়ান্ত হামলার জন্য আমরা এই দিনটিকে বেছে নিয়েছিলাম। এরপর থেকে তাদের ওপর বিরতিহীন হামলা করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। পরে ১০ ডিসেম্বর বিকেলে মেঘনা নদীর পাশে তৎকালীন গজারিয়া থানায় পরাজয় স্বীকার করে ৬০ জনেরও বেশি সেনা সদস্য আত্মসমর্পণ করে। টানা ৮ মাস যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত হয় গজারিয়া। তবে গজারিয়ায় যে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী, তার ক্ষত আজও শুকায়নি। তাই প্রতিবছর ৯ মে গজারিয়াবাসী এ দিনটি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। পালন করে নানা কর্মসূচি।
প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের যেসব অঞ্চলে গণহত্যা সংঘটিত হয়, এর মধ্যে গজারিয়া গণহত্যা অন্যতম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছর হতে চলল, রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৩৮ কিলোমিটার অদূরে পাকিস্তানি বাহনীর নৃশংস গণহত্যার সাক্ষী সেই বধ্যভূমিগুলো আজও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। নেওয়া হয়নি তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগও।
মন্তব্য করুন