ঘুরে ফিরে সুন্দরবনের একই জায়গায় গত দুই যুগে ২৫ বার আগুন লেগেছে। এতে প্রায় ১শ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রত্যেকবারই তদন্ত কমিটি করা হয়। আর প্রত্যেকবারই কাছাকাছি একই প্রতিবেদন দাখিল করে বন বিভাগের তদন্ত কমিটি। কমিটির সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় পরের বছর একই এলাকায় আবারও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এতে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের সুন্দরবনের অনেক জায়গায় বনভূমি উজাড় হয়ে পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অপরিকল্পিত প্রকল্পে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের ওই অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ঘুরে ফিরে একই জায়গায় আগুন
প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী পশ্চিম বন বিভাগের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিগত দুই যুগে সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের এই জায়গাটিতে অন্তত ২৫ বার আগুন লেগেছে। গত ৫৪ বছরে এ সংখ্যা ৪০। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাবাড়িয়ায় দুবার। ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া সুতার খাল এলাকায় দুবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমুরবুনিয়া, ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার। ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার। ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোরালিয়ায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার, ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায়। এ ছাড়া ২০২১ সালের ৩ মে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় এবং সর্বশেষ তিন দিন আগে চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে। এবারও তারা আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে একটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান বন সংরক্ষক বলেন, আমরা এখন সবাই ব্যস্ত আগুন নেভানোর জন্য। আমি নিজেও আগুন নেভানো ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। সুতরাং যেসব কারণে আগুন লাগতে পারে কোনো কারণকেই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। মৌয়ালের কারণেও আগুন লাগতে পারে। যারা মাছ ধরে তারা ইচ্ছা করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে- এটিও আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। আবার দুর্ঘটনাবশত কারও হাত থেকে আগুন পড়ে গিয়েও লাগতে পারে, সেটিও আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সবগুলো সম্ভাবনা হাতে রেখেই আমরা কাজ করছি। আগের করা ২৪টি তদন্ত প্রতিবেদনের অন্তত ১৫টি প্রতিবেদনে বনজীবীদের ফেলে আসা আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত উল্লেখ করা হয়েছে। জেলে ও মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকে আগুনের সূত্রপাতের কথা বাকি প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরিকল্পিত নদী খনন কাল হয়েছে
বন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে গত দুই দশকে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এর সব কটি ঘটনাই ঘটেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে সুন্দরবনের ভোলা ও মরা ভোলা নদীসংলগ্ন এলাকায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলামের মতে, পূর্ব সুন্দরবনের দুটি নদী অপরিকল্পিতভাবে খনন করে মাটি তুলে এমনভাবে রাখা হয়েছে, বাঁধের মতো হয়ে গেছে। ফলে জোয়ারভাটার পানি প্রবেশ না করায় সেখানকার ভূমিটা একবারে শুষ্ক থাকে। বর্ষা মৌসুমের আগে আগে এটা আরও শুষ্ক হয়ে যায়। সেজন্য এখানে আগুন সহজভাবে ধরতে পারে।
তিনি বলেন, বনের মধ্যে পানিপ্রবাহ না থাকা বড় একটা ইস্যু হয়ে গেছে। এজন্য বড় ধরনের একটা প্রকল্প দরকার। বাংলাদেশ বন বিভাগের সঙ্গে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখা, নদীশাসনের কাজ যারা করেন, তাদের সবার একটা সমন্বয় দরকার। একটা পরিকল্পিত পদ্ধতিতে প্রকল্পটা নেওয়া দরকার। কারণ, আগের মতো প্রকল্প নিয়ে যদি মাটি বনের মধ্যে ফেলা হয় এবং বনকে যদি উঁচু করে দেওয়া হয়; তবে ম্যানগ্রোভের জন্য যে পরিবেশ লাগে, সেটা নষ্ট হবে। তখন নতুন প্রকল্পেও কোনো লাভ হবে না।
এদিকে প্রায় ২৫ ঘণ্টা পর সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। সোমবার থেকে আগুনের এলাকা ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলের বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর একাধিম টিম রয়েছে। কোথাও ধোঁয়া দেখা গেলে সেখানে সঙ্গে সঙ্গে পানি ছেটানো হচ্ছে। বন বিভাগের ২৫টি টিম, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বিমানবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
মন্তব্য করুন