রাজশাহীতে একটি সমবায় সমিতির নামে লিজ নেওয়া সরকারি একটি খাসজমি রাতারাতি দুই কোটি টাকায় বিক্রির পাঁয়তারা চলছে। এ জন্য রাজশাহীর ধনাঢ্য দুই ব্যক্তির সঙ্গে হস্তান্তর নামা একটি দলিলও করা হয়েছে। ভয়াবহ এই অনিয়মের ব্যাপারে সমিতিরই এক সদস্য বাদী হয়ে মামলাও করেছেন। জেলা প্রশাসন বলছে, লিজ নেওয়া খাসজমি বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।
ওই সমিতির নাম রাজশাহী রিফিউজি কো-অপারেটিভ স’মিল লিমিটেড। এটি ভারত থেকে রাজশাহীতে আসা মুহাজির বা রিফিউজি কাঠ মিল ব্যবসায়ীদের সংগঠন। ১৯৫২ সালে সমিতিটি নিবন্ধন পায়। এর নিবন্ধন নম্বর-২২। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জেলা প্রশাসক রাজশাহী নগরীর গোরহাঙ্গা এলাকায় ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত সাড়ে ১৪ কাঠা খাস জমি সমিতিটিকে ইজারা দেয়। এখনও ওই ইজারা চলমান।
আইন অনুযায়ী, লিজ নেওয়া খাসজমি বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু গত ৩ মার্চ এই সম্পত্তি বিক্রির জন্য নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে হস্তান্তরনামা দলিল করা হয়েছে। তেলেসমাতি এই কারবারে দলিলের প্রথম পক্ষ হিসেবে সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার আনসারী, সাধারণ সম্পাদক আসলাম পারভেজ, সদস্য আরিফ ইকবাল, মো. সরফরাজ ও জুলেখা খাতুন নুরীর নাম লেখা হয়েছে। আর ক্রেতা হিসেবে দ্বিতীয়পক্ষে আছেন নগরীর হেতেমখাঁ এলাকার ব্যবসায়ী আরিফুজ্জামান সরকার ও তার ভাই আশাফউজ্জামান সরকার।
দলিলে উল্লেখ রয়েছে, দুই কোটি ৫ লাখ টাকায় এই জমিটি বিক্রি করা হচ্ছে। চুক্তির দিন দ্বিতীয় পক্ষ প্রথমপক্ষকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া এনআরবিসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ৫৫০৫২২০ নম্বর চেকে গত ৩১ মার্চের তারিখে এক কোটির একটি চেক দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৫৫০৫২২১ নম্বর চেকে আরও একটি এক কোটি টাকার চেক দেওয়া হলো। দ্বিতীয় চেকটি নগদায়ন করা যাবে আগামী ৩১ মে। সেদিন চেকে টাকা উঠানো না গেলে চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। রাজশাহী নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে এই হস্তান্তরনামা দলিলের নিবন্ধন নম্বর-০০০০১৮২১।
নগরীর প্রাণকেন্দ্রের মহামূল্যবান এই জমি বিক্রির অপচেষ্টার বিষয়ে জানতে পেরে গত ৩ এপ্রিল সমিতির সহসভাপতি মো. সোবহান বাদী হয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি মামলা করেছেন। এতে আরিফউজ্জামান সরকার, তার ভাই আশিক উজ্জামান সরকার, বিপ্লব সরকার এবং তাদের সহযোগী এমদাদুল হক বাবুকে আসামি করা হয়েছে। তারা অবৈধভাবে জমিটি দখলের চেষ্টা করছেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার বাদী মো. সোবহান বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে এই জমির ইজারা চলে আসছে। এ জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখায় নিয়মিত লিজের অর্থ জমা দিতে হয়। সরকারি এই জমি বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সমিতির সভাপতি-সম্পাদকসহ পাঁচ সদস্য আর্থিকভাবে লাভবান হতে অবৈধভাবে জমিটি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এমদাদুল হক বাবু জমি কেনার জন্য টাকা দিচ্ছেন। তাই মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।’
এদিকে সমিতির পাঁচ সদস্যের সঙ্গে জমি কেনার জন্য হস্তান্তরনামা দলিল করার পর থেকেই আসামিরা জমিটি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন। জমিতে সমিতির পক্ষ থেকে বেশকিছু দোকানপাট করে ভাড়া দেওয়া আছে। ভাড়াটিয়ারা জানান, সম্প্রতি মামলার এই আসামিরা গিয়ে তাদের দোকান ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেছেন। তারা দোকান ছাড়তে না চাইলে গালিগালাজ করা হয়। আসামিরা তাদের কাছে দাবি করেছেন, জমির মালিক এখন তারা। এ সময় সমিতির আরেক সদস্য মো. আলমগীর বাধা দিতে গেলে আসামিরা তাকে ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ নিয়ে আলমগীর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
হস্তান্তরনামা দলিল করার কথা স্বীকার করলেও সবকিছু পড়ে দেখেননি বলে দাবি করেছেন স’মিল সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার আনসারী। তিনি স্বীকার করেন, লিজ নেওয়া এই জমি বিক্রির ক্ষমতা তার নেই। এরপরও দলিল করার কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দেননি।
খাস জমি কিনতে হস্তান্তরনামা দলিল করার বিষয়ে কথা বলতে আরিফুজ্জামান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তার ভাই বিপ্লব সরকারকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও ধরেননি। তাদের সহযোগী এমদাদুল হক বাবু বলেন, ‘এই জমির মূল মালিক আরিফুজ্জামান সরকারের প্রয়াত বাবা। যেভাবেই হোক এখন এটার দখলে আছে স’মিল সমিতি। তাই তাদের কাছ থেকে আপসে জমির দখল নিতে দুই কোটি টাকার চুক্তি করা হয়েছে।
তবে সবশেষ ২০২৩ সালের ১ আগস্ট রাজশাহীর বড়কুঠি ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মেহেদী হাসানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ৪৫৩৬ ও ৪৭১৯ নম্বর দাগের এই জমির শ্রেণি স’মিল। এটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ডেপুটি কমিশনার, রাজশাহী নামে প্রচলিত। দাগে মহাজেরিন সমবায় সমিতি লেখা আছে।
লিজ দেওয়া এই জমি বিক্রির চেষ্টার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘লিজ নেওয়ার পর খাস জমি বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের আইনগত কোনো সুযোগ নেই। আমি ঢাকায় প্রশিক্ষণে আছি। ফেরার পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
মন্তব্য করুন