মেহেরপুরে স্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ উঠেছে কথিত দুই সাংবাদিক মো. আব্দুর রউফ ও মো. মহসিন আলীর বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ওবায়দুল্লাহ বিষয়টি নিয়ে মেহেরপুর সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ হস্তান্তর করেছেন। মেহেরপুর সদর থানার ডিউটি অফিসার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
মেহেরপুর সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী মো. ওবায়দুল্লাহর (৪৮) দায়ের করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, মো. আব্দুর রউফ (৫৮) ও মো. মহসিন আলী (৬০) নিজেদের স্থানীয় দৈনিক আমাদের সূর্যোদয় পত্রিকার প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার ওবায়দুল্লাহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যান। এ সময় তারা তাকে সুদি ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে বলেন জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে তার অপকর্মের সকল প্রমাণ রয়েছে। এ সময় তারা তাকে ভয়ভীতি দেখান এবং মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন।
এ সময় বলেন, তাদের টাকা দিলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে তারা হুমকি দেন যে, টাকা না দিলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে খবর প্রকাশ করা হবে। পরে তারা ব্যবসায়ী ওবায়দুল্লাহর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন এবং পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরও ১ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য আলটিমেটাম দেন। এরপর বুধবার ২৪ এপ্রিল বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে আব্দুর রউফ ০১৭১৬১৩৪৮৩০ নম্বর থেকে ওবায়দুল্লাহকে কল দিয়ে আবারো ১ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে হুমকিধমকি দিলে তিনি থানায় এসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
এ সময় তিনি তার প্রতিষ্ঠানে সিসিটিভি ক্যমেরায় ধারণকৃত পূর্বে চাঁদা প্রদানের ভিডিওটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন।
উল্লেখ্য, নব্য সাংবাদিক সাজা আব্দুর রউফ ইতোপূর্বে আইনবহির্ভূতভাবে নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দেওয়া এবং চিকিৎসাসেবা দেওয়ার অপরাধে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত দ্বারা দণ্ডিত হয়েছেন। বিগত তিন চার দিন যাবৎ তিনি আবার নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
মেহেরপুর জেলা তথ্য অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, এ ধরনের ব্ল্যাকমেইল ও চাঁদাবাজির ঘটনা প্রকৃত সাংবাদিকদের মান ক্ষুণ্ণ করে। এদের বিরুদ্ধে জেলার সকল সাংবাদিকদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। ভুক্তভোগীকে অনুরোধ করব পুলিশের পাশাপাশি জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিতে। জেলা প্রশাসক একটি কমিটি গঠন করে দিলে সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা অভিযুক্ত কথিত সাংবাদিকদের কালো তালিকাভুক্ত করব। যাতে তারা পরবর্তীতে নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা না নিতে পারে।
কথিত সাংবাদিক আব্দুর রউফ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৪ সালে গাংনী উপজেলার বামন্দী ইউনিয়নের চেরাগী পাড়ার ফর্মান আলী নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ডোমকল থেকে বাংলাদেশে আসেন আব্দুর রউফ। সেই সময় তার ঠোঁটের ওপর কাটা দাগ ছিল, যা আঞ্চলিক ভাষায় গর্ণা কাটা বলে পরিচিত। তিনি সেই সময় এলাকায় ঠান্ডা জ্বর নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করলে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন ভারতীয় গর্ণা কাটা ডাক্তার হিসেবে।
২০০৭ সালের দিকে বামন্দী আলহেরা ফার্মেসিতে অস্থায়ী চেম্বার খুলে রোগী দেখা শুরু করেন। একপর্যায়ে আব্দুর রউফ তার ঠোঁট অপারেশন করে গর্ণাকাটা সারিয়ে ফেলেন। সেই সময় গাংনী র্যাব ক্যাম্প বামন্দীর আলহেরা ফার্মেসিতে অভিযান পরিচালনা করে ভুয়া ডাক্তার হিসেবে আব্দুর রউফকে অর্থদণ্ড প্রদান করে এবং রোগী দেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর আব্দুর রউফ মেহেরপুরে চলে আসেন এবং শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি ফার্মেসিতে আবার চেম্বার খুলে বসেন। অতঃপর মেহেরপুরের এক নারীকে বিয়ে করে মেহেরপুরের স্থানীয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
অভিযুক্ত অপর সাংবাদিক মো. মহাসিন আলী বেশ কয়েক বছর আগে মেহেরপুর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের একটি ফাঁকা জায়গায় চায়ের দোকান পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার চায়ের দোকানে জেলার বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সংবাদকর্মীরা চা খেতে যেতেন। সেই সুবাদে প্রথমে তিনি পত্রিকার হকারি ব্যবসা শুরু করেন। পরে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকাতে ছড়া-টিপ্পনী লিখতেন। বর্তমানে মেহেরপুরের গাংনী থেকে প্রকাশিত ডিএফপি বহির্ভূত পত্রিকা আমাদের সূর্যোদয়ের সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত।
মেহেরপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অলক কুমার দাস কালবেলাকে বলেন, মাত্র কিছুদিন পূর্বে নিয়মবহির্ভূতভাবে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার অপরাধে আমরা আব্দুর রউফকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। চিকিৎসা সেবা সম্পর্কিত তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই। বাংলাদেশের চিকিৎসা করার জন্য বিএমডিসির ছাড়পত্র বা অনুমোদন তার নাই। কিন্তু সে নিজের নামের পূর্বে ডাক্তার লিখে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়। হঠাৎ করে দুই তিন দিন যাবৎ শুনছি আব্দুর রউফ একজন সাংবাদিক। হয়তো নিজের অপকর্ম ধামাচাপা দিতেই এখন এই রূপ ধারণ করেছে।
অভিযুক্ত সাংবাদিক মো. মহাসিন আলীকে ব্ল্যাকমেইল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ওবায়দুল্লাহ একজন সুদ ব্যবসায়ী। আমার কাছে সব রেকর্ড আছে। নিউজ তৈরি হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজে টাকা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান। আবারো বলেন, আমার কাছে সব রেকর্ড আছে আমি নিউজ লিখছি।
ডিএফপির স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকা স্থানীয় দৈনিক আমাদের সূর্যোদয়ের প্রকাশক ও সম্পাদক আবুল কাশেম অনুরাগী কালবেলাকে বলেন, মাত্র একদিন আগে আব্দুর রউফকে আমি আমার প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড দিয়েছি। তবে মহসিন আলী দীর্ঘদিন ধরে আমার পত্রিকায় কাজ করছে। কখনো তার বিরুদ্ধে আমি এ ধরনের অভিযোগ শুনিনি। আপনি যদি কোনো তথ্য প্রমাণ পান আমাকে জানাবেন। আমি নিজেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কোনো ব্যক্তির অপকর্মের দ্বায় আমার প্রতিষ্ঠান ও আমি নেবো না।
মেহেরপুর সদর থানার ওসি সেখ কনি মিয়া চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে কালবেলাকে বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান চলছে। পরবর্তীতে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটা আমি জেনে আপনাকে নিশ্চিত করব।
মন্তব্য করুন