কয়েকদিন থেকেই তীব্র তাপদাহে বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী যেন খাঁ-খাঁ করছে। বাইরে বেরুলেই রোদ গায়ে বিঁধছে আগুনের হলকার মতো। রোদের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ায় বাতাসেও যেন আঁচ করা যাচ্ছে আগুনের মিশ্রন। কয়েকদিনের তীব্র তাপদাহে মানুষ, গাছপালা ও প্রাণিকূলে তৈরি হয়েছে চরম নাভিশ্বাস। শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে বেশ কিছুদিন থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলে নেই বৃষ্টিপাত। প্রচণ্ড খরার কারণে আমের জন্য বিখ্যাত রাজশাহীতে ঝরে যাচ্ছে আমের গুটি। এতে করে আম চাষিরা চলতি মৌসুমে চরম লোকসানে পড়তে যাচ্ছেন।
রাজশাহীর আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি মৌসুমে আমের মুকুল অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম। তার ওপর আবার আমের মুকুল আসার পর থেকেই খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টি হয়নি। এতে করে বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। পাশাপাশি তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা হ্রাস পাওয়ায় আমসহ বিভিন্ন ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে। আম গাছে পানির সেচ ও কিটনাশক প্রয়োগ করেও আমের গুটি রক্ষা করতে পারছে না এই অঞ্চলের আমচাষিরা। সবমিলে এই মৌসুমে আমচাষিরা চরম লোকসানে পড়তে যাচ্ছেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
চাষিরা বলছেন, প্রতি বছর আমের গুটি ঝরে। যাকে তারা সাধারণ গুটি ঝরা হিসেবে ধরে নেন। কিন্তু এ বছর দীর্ঘ দিন থেকে খরার কারণে সাধারণের চেয়ে বেশি আমের গুটি ঝরছে। তাদের ধারণা ইতোমধ্যে অনেক বাগানে ১৫ থেকে ২০ ভাগ আমের গুটি ঝরে গেছে।
আম গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৯ মার্চ রাত দুইটা থেকে পরের দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ১০ মিলিমিটার। তার আগে ৪ মার্চ ১ মিলিমিটার ও পরের দিন ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এরপর রাজশাহীতে আর কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। যে সময় সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল তখন আমগাছগুলোতে মুকুল ছিল। বৃষ্টির আগে শুষ্ক আবহাওয়া ও বৃষ্টির পরে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার এক-দুইদিন পরে রোদ। এই রোদে আমের মুকুল পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এই ধকলের পরে শুরু হয়েছে খরা। খরার কারণে এখন ঝরছে গাছে অবশিষ্ট থাকা আমের গুটি।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন- রাজশাহী জেলার বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আমের চাষ হয়। এ বছর এসব উপজেলার আমের বাগানগুলোতে মুকুল কম এসেছে। বেশির ভাগ গাছে আমের মুকুলের পরিবর্তে গজিয়েছে নতুন পাতা। এ ছাড়া অনেক গাছে নতুন পাতা না আসলেও মুকুল আসেনি। যদিও সেই গাছগুলোতে গেল বছর আম এসেছিল। কিন্তু এই বছর নেই। আবার যে গাছগুলোতে আমের মুকুল ছিল, সেগুলো আবার গুটিতে ঝরে গেছে। গুটি ঝরা ঠেকাতে সেচ দিচ্ছেন অনেকেই।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর রাজশাহী জেলার ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ২৪ হেক্টর বেশি। আর গতবার জেলার ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছিল। চলতি বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৫ টন। কিন্তু আমের আশঙ্কাজনকহারে আমের গুটি ঝরে পড়ায় এই লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা আমচাষিদের।
চারঘাটের আমচাষি হাসান আলী বলেন, তার তিনটি বাগানে ৭৫টি আমের গাছ রয়েছে। তার মোট গাছের তিন ভাগের একভাগ গাছেও আম নেই। তার দাবি এ বছর মুকুল আসেনি। তার পরেও যে কয়েকটা গাছে মুকুল ছিল। তাও আবার গুটিতে ঝরে যাচ্ছে। সবমিলে এ বছর আমের উৎপাদন অনেক কম হবে।
বৈরী আবহাওয়া আমের গুটি ঝরে পড়ার দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে আমচাষি আব্দুস সালাম বলেন, আমের জন্য এ সময়ে বৃষ্টি খুব প্রয়োজন। বৃষ্টি হলে আশা করা যায় আমের গুটি ঝরা বন্ধ হয়ে যাবে। তা না হলে তীব্র তাপে গাছের আমের আরও বেশি গুটি ঝরে যাবে। গাছ থেকে স্বাভাবিক আমের গুটি ঝরে। কিন্তু বর্তমানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আমের গুটি ঝরছে। তার হিসেবে গাছের ১০ থেকে ১৫ ভাগ আমের গুটি ঝরে গেছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার আম কম হবে। বিগত বছরের তুলনায় আমের মুকুলও কম ছিল। এবছর মুকুলে ফুল ফোটার সময়ে গত ২০ মার্চ বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ফলে আমের অনেক মুকুল নষ্ট হয়ে গেছে। যেহেতু গেল বছর আমের বাম্পার ফলন হয়েছিল। এই বছর বেশির ভাগ গাছে নতুন পাতা দেখা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামি বছরে আমের ভালো ফলন হতে পারে। তিনি বলেন, যেহেতু তাপমাত্রা বেশি। তাই আমের গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। তাহলে আমের গুটি ঝরা রোধ হয়ে যাবে। ফলে কিছুটা হলেও উপকার পাওয়া যাবে সেচ দিয়ে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। প্রচণ্ড খরার কারণে আমের মুকুল ঝরে পড়ছে। রাজশাহীতে এমনিতেই মুকুল এবার অনেক কম এসেছিল। আর খরার কারণে আমের মুকুল ঝরে পড়ায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তারপরও আমচাষিদের গুটি ঝরে পড়া রোধে নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, শনিবার রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন শুক্রবার রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিলো ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বৃহস্পতিবারও তাপমাত্রা প্রায় একই ছিল। আর শনিবার বিকেল ৩টায় বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩ শতাংশ।
কয়েক দিন ধরেই আর্দ্রতার পরিমাণ অনেক কম। ফলে সবকিছুই পুড়ে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকায় গাছে আমের মুকুলও শুকিয়ে বোটা থেকে খসে পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন এ আবহাওয়াবিদ।
মন্তব্য করুন