পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে প্রাচীন বাংলার রাজধানী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ছিল বিনোদনপ্রেমী দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। সোনারগাঁয়ে অবস্থিত লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, বাংলার তাজমহল ও পিরামিড, ঐতিহাসিক পানাম নগরী, বারদীতে জ্যোতিবসুর জাদুঘর, বৈদ্যেরবাজার মেঘনা নদীর ঘাট, কাইকারটেক ব্রিজ , অলিপুরা ব্রিজ, হরিহরদি ব্রিজ, দ্বিতীয় মেঘনা সেতুর এলাকাসহ কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে দর্শনার্থীদের উপস্থিতিতে মিলনমেলায় পরিণত হয়। লোককারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বর, বাংলার তাজমহল ও পিরামিডের ভেতরের সাজসজ্জা ছিল এবারের ঈদে পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ।
রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে হওয়ায় সোনারগাঁ ভ্রমণে এসে মনোরম পরিবেশে আনন্দ উপভোগ করেছেন দর্শনার্থীরা। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বিশেষ করে উঠতি বয়সী যুবক-যুবতিদের পদচারণায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল পর্যটন কেন্দ্রগুলো।
এ ছাড়া মেঘনা নদীর ভাটিবন্দর থেকে কান্দারগাঁও পর্যন্ত নদীর পাড়, অলিপুরা ব্রিজ এলাকায় নদী-গাছপালা ইত্যাদি প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য দেখতেও ভিড় ছিল লক্ষণীয়। এসব দর্শনীয় স্থানে পসরা সাজিয়ে বসেছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের খেলাধুলা ও সাজসজ্জার ভ্রাম্যমাণ দোকান। দর্শনার্থীরা ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি তাদের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে নেচে গেয়ে উপভোগ করেছেন রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার বিনোদনপ্রেমীরা। এবার বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো।
বাংলার তাজমহলের প্রতিষ্ঠাতা ও চিত্র পরিচালক আহসান উল্যাহ মনির সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বাংলার তাজমহলে ও পিরামিডে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় ছিল।
পানাম নগরীর দায়িত্বে থাকা বুকিং সহকারী মঞ্জুর হোসেন জানান, এবারে আশানুরূপ দর্শনার্থীদের সমাগম হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ কয়েক হাজার দর্শনার্থী প্রতিদিন পানাম নগরীর আদিরূপ উপভোগ করতে ভিড় জমাচ্ছে। রীতিমতো হিমশিম পোহাতে হচ্ছেও বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের (সোনারগাঁও জাদুঘর) পরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান কালবেলাকে বলেন, এবার পর্যটকদের একটু ভিন্ন আয়োজন করা হয়েছে। জাদুঘর চত্বরে এবার ১৫ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। পর্যটকরা যেন ঈদের ছুটিতে ঘুরতে এসে বৈশাখী মেলাও উপভোগ করতে পারে। সেই সঙ্গে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, গত রোববার দুপুরে এ মেলার উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান। মেলায় গ্রামবাংলার কারুশিল্পী প্রদর্শনীতে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি শিল্পী সুশান্ত পাল, রিকশা ও রিকশা চিত্রশিল্পী এস এ মালেক, জামদানি শিল্পী ইব্রাহিম, দারুশিল্পী আব্দুল আওয়াল মোল্লা, বীরেন্দ্র সূত্রধর, শোলাশিল্পী নিখিল মালাকার, নকশিকাঁথা শিল্পী পারভীন আক্তার, হোসনে আরা বেগম, ঝিনুকশিল্পী মো. নূরুল ইসলাম, বাঁশ-বেত কারুশিল্পী পরেশ চন্দ্র দাস, হাতপাখা কারুশিল্পী বাসন্তী সূত্রধর, শতরঞ্জি শিল্পী আনোয়ার হোসেন এবং উদ্যোক্তাসহ ৩২টি স্টলে ৬৪ জন প্রথিতযশা কারুশিল্পী তাদের কারুপণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন।
অপরদিকে, প্রায় ১০ বছর পর বৈশাখ উপলক্ষে উপজেলা মঙ্গলেরগাঁও বটতলা মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় শত বছরের আদি বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে উপজেলার ভট্টপুর জয়রামপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় বউ মেলা। যা হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে বটবৃক্ষটি সিদ্ধেশ্বরী দেবতা নামে সুপরিচিত। বটতলার পদতলে (সনাতন) হিন্দু সম্প্রাদায়ের শত শত নর-নারী পহেলা বৈশাখের এ পূজায় অংশগ্রহণ করেন। পূজা-অর্চনা একদিনের হলেও মেলা জমে তিন দিন। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে সিদ্ধেশ্বরী কালী তলার এ বউ মেলার জন্য। বউ মেলার পাশাপাশি দেবতার সন্তুষ্টির জন্য কবুতর উড়ানো ও পাঁঠা বলি দেওয়া হয় বৃক্ষ দেবতার পদতলে স্বামী সংসারের বাঁধন যেন অটুট থাকে, সারা বছর সুখ শান্তিতে যেন কাটে দাম্পত্য জীবন- এই কামনাতেই পূজার আয়োজন করে হিন্দু নারীরা।
বউ মেলা আয়োজক কমিটির কর্মকর্তা নীলোৎপল রায় বলেন, প্রতিবছর বর্ষবরণ উৎসবে সিদ্ধেশ্বরী কলীপূজার আয়োজন করা হয়। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সার্বজনীনভাবে এ মেলার আয়োজন করেন। এ পূজায় দেশবাসী ও এলাকার মানুষের শান্তি ও মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করা হয়।
পূজা অর্চনা ছাড়াও বউ মেলায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ বউ মেলায় দারু ও মৃৎ শিল্পীদের তৈরি নানা রঙের নানা বর্ণের টেপা পুতুল, হাতি, ঘোড়া, ময়না, টিয়া, বাঘ-ভাল্লুক, হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে মন্ডা-মিঠাইয়ের দোকান বসে। বিভিন্ন মনোহারি জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে বসে মেলায়। মৃৎশিল্প, লৌহশিল্প, কাঠ ও বাঁশের তৈরি লোক পণ্য ছাড়াও মেলায় পাওয়া যায় বাহারী মিষ্টান্ন সামগ্রী। সোনারগাঁয়ের বউমেলা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ জানান, সোনারগাঁয়ে বেশকিছু পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হওয়ায় পর্যটক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে সোনারগাঁয়ের দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি থানা পুলিশের মাধ্যমে অতিরিক্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন