শাজাহানপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ছাত্রলীগ-যুবলীগ পিটিয়ে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছেলেকে নিয়ে গেলেন এমপি

বগুড়া-৬ (সদর) আসনের এমপি রাগেবুল আহসান রিপু। ছবি : সংগৃহীত
বগুড়া-৬ (সদর) আসনের এমপি রাগেবুল আহসান রিপু। ছবি : সংগৃহীত

বগুড়ায় সদর আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) রাগেবুল আহসান ওরফে রিপুর উপস্থিতিতে সদর পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের পেটানোর অভিযোগ উঠেছে।

রোববার (৭ এপ্রিল) রাত ১১টায় বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়িতে এ ঘটনা ঘটেছে।

জানা যায়, রোববার রাতে সাইরেন বাজিয়ে সংসদ সদস্যের (এমপি) স্টিকার লাগানো একটি গাড়ি বেপরোয়া গতিতে ঢোকে সদর পুলিশ ফাঁড়িতে। পেছনে মোটরসাইকেলের বিশাল বহর, সেখানে অর্ধশত দলীয় কর্মী। গাড়ি থেকে নামেন বগুড়া-৬ (সদর) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু। এরপর ইশারা পেয়েই পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরে যুবলীগের দুই নেতার ওপর হামলে পড়ে এমপি বাহিনীর সদস্যরা।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাঁড়ির মধ্যে পিটিয়ে আহত করা হয় জেলা যুবলীগের উপপ্রচার সম্পাদক জিহাদুল শরিফ পরাগ ও সদস্য মোহাম্মদ আদনানকে। তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ফাঁড়িতে আটকে থাকা ছেলে প্রতিত আহসানকে গাড়িতে নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে বেরিয়ে যান এমপি ও তার দলবল।

জানা যায়, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘটনার শুরু। রোববার রাত ১১টার দিকে শহরের সাতমাথায় জিলা স্কুলের সামনে রাস্তা পার হচ্ছিলেন শাজাহানপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রঞ্জু। এ সময় শিবগঞ্জের পিরব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসিফ মাহামুদের ছেলে আবিরের মোটরসাইকেলের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। এ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা রঞ্জু ও চেয়ারম্যানপুত্র আবির বাগবিতণ্ডায় জড়ান। একপর্যায়ে রঞ্জুর পক্ষ নিয়ে যুবলীগ নেতা পরাগ ও আদনান এগিয়ে আসেন। তারা আবির ও তার সঙ্গে থাকা এক বন্ধুকে মারধর করেন। এ খবর আবির তার বন্ধু এমপিপুত্র প্রতিতকে জানায়। তখন বন্ধুর ওপর হামলার শোধ নিতে আরও ৫টি মোটরসাইকেলে ১০ জন নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় প্রতিত। তারা সেখানে ছাত্রলীগ নেতা রঞ্জুসহ যুবলীগের ওই দুই নেতার ওপর হামলা ও মারধরের চেষ্টা করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা হট্টগোল দেখতে পেয়ে এমপিপুত্র প্রতিত, ছাত্রলীগ নেতা রঞ্জুসহ দুপক্ষের ১০ থেকে ১২ জনকে আটক করে সদর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে উভয়ের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মিটমাটের চেষ্টা চালান সদর পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর সুজন মিয়া।

এদিকে ছেলেকে আটকের খবর পেয়ে এমপি রিপু তার অর্ধশত অনুসারী নিয়ে ছুটে যান। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে ওই দুই যুবলীগ নেতাকে পেটাতে থাকে এমপির কর্মীরা। এ সময় পুলিশ সদস্যরা বাধা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে দর্শক বনে যান। সেখানে উপস্থিত গাবতলী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুর রহমান মুক্তাও এমপি অনুসারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এমপি সাহেবের কর্মকাণ্ড দেখে আমি হতবাক।

তিনি আরও বলেন, মারধর শেষ হলে এমপি রিপু ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক সুজন মিয়াকে ধমক দিয়ে বলেন, অফিসার, আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেছে? তার বিরুদ্ধে কী কোনো আইনিব্যবস্থা নেবেন? আদালতে পাঠাবেন? উত্তরে ইনচার্জ বলেন, আপনার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি, স্যার। তাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।

এদিকে এমপি রিপু তার ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের নিয়ে চলে গেলে পুলিশ হামলায় আহত দুজনসহ অপর পক্ষের চারজনকে ফাঁড়িতে আটকে রাখে।

আটককৃতরা হলেন ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রঞ্জু, যুবলীগ নেতা জিয়াদুল শরিফ পরাগ, মোহাম্মদ আদনান ও মোহাম্মদ রঞ্জন। পরে রাত ১টার দিকে পরাগ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পুলিশের হেফাজতে সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এরপর আটক অন্য তিনজনকে ভোরে সদর পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে মারধরের স্থান ও গেটে ৪টি সিসি ক্যামেরা থাকলেও অজানা কারণে সেগুলোতে কিছুই রেকর্ড হয়নি।

পুলিশ বলছে, হার্ডডিস্ক নষ্ট হয়ে গেছে। সদর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) সুজন মিয়া বলেন, সাতমাথায় দুপক্ষের হট্টগোলের মীমাংসা করিয়ে দিতে তাদের ফাঁড়িতে আনা হয়েছিল। সেখানে এমপি স্যারের ছেলেও ছিল। এমপি স্যার জানতে পেরে ছেলেকে নিতে আসেন। ওই সময়ে কিছু লোকজন যুবলীগের দুই নেতাকে কেন মারধর করল, বুঝতে পারিনি।

মারধরের শিকার যুবলীগ নেতা জিহাদুল শরিফ পরাগ বলেন, সাতমাথায় এমপিপুত্রের বন্ধুদের আমি মারিনি। ঝামেলা দেখতে পেয়ে পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে আসি। হঠাৎ ফাঁড়িতে এমপির অনুসারীরা হামলা করে। এমপির ইশারাতেই তারা মারধর করেছে। ফাঁড়িতে পুলিশের উপস্থিতিতে একজন এমপি এমন সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারে, এটা বিশ্বাস হয় না। আমিও তো তার দলের মানুষ। কিছু না শুনেই তারা আমাকে পেটাল।

শাজাহানপুর ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রঞ্জু বলেন, আমার শরীরে মোটরসাইকেলের ধাক্কা দিয়ে এমপিপুত্র আর তার বন্ধুরা হট্টগোল শুরু করে। ফাঁড়িতে গিয়ে মীমাংসার সময় এমপি এসে কোনো কথা না শুনেই তার অনুসারী দিয়ে মারধর করান। পরে উল্টো তার নির্দেশে পুলিশ ভোর পর্যন্ত আমাদের ফাঁড়িতে আটকে রাখে।

ঘটনার বিষয়ে এমপি রিপুর মোবাইলে একাধিকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে তিনি অন্য এক গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি ছেলেকে নিতে পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে কারা মারধর করেছে, আমি জানি না। ঘটনাটি দুঃখজনক।

বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ বলেন, সাতমাথা থেকে কয়েকজনকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসার পর অভিভাবকের জিম্মায় সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে ফাঁড়িতে কাউকে মারধরের বিষয়ে আমার জানা নেই। তখন সেখানে আমি ছিলাম না, পরে গিয়েছি।

দুই নেতার ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে জেলা যুবলীগ। দপ্তর সম্পাদক জাকারিয়া আদিলের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে হামলাকারীদের ‘কতিপয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে শাস্তি দাবি করা হয়। তবে এমপির উপস্থিতির বিষয়টি এড়িয়ে গেছে যুবলীগ। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু বলেন, এমপির উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটল, সেটার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে দুই নেতার ওপর হামলার প্রতিবাদ ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে শহর যুবলীগ সোমবার বিকেলে সাতমাথায় মানববন্ধন করে। দলীয় সভাপতি মাহফুজুল আলম জয়ের সভাপতিত্বে কর্মসূচিতে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রশাসনকে ৭২ ঘণ্টার সময় দেওয়া হয়।

এমপিপুত্রের যত কাণ্ড

সম্প্রতি শহরের মধুবন সিনেমা হলের সামনে থেকে ২২ বছর বয়সী এক যুবককে তুলে নিয়ে যায় এমপিপুত্র ও তার সহযোগীরা। পূর্বশত্রুতার জের ধরে তারা ওই যুবককে এমপির বাড়ির ছাদে নিয়ে পিটিয়ে আহত করে। বিষয়টি ওই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এমপি ওই যুবককে বগুড়া শহর থেকে সরিয়ে দেন এবং পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখেন।

এ ব্যাপারে পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান আকন্দ বলেন, এমপিপুত্র বগুড়ায় একটি কিশোর গ্যাং চালায়, যা শহরবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। বাবা হিসেবে এমপির উচিত ছেলেকে শাসন করা। তবে তিনি তা কখনোই করেন না।

অঢেল টাকায় বেপরোয়া চালচলন

২০১৯ সাল থেকে এখনো বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন রাগেবুল আহসান রিপু। ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে বগুড়া-৬ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি নৌকা নিয়ে জয়লাভ করেন। মূলত, এ পদটি তাকে শূন্য থেকে টেনে তোলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, বগুড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে শুরু থেকে বিতর্কে জড়ান রিপু। তার বিরুদ্ধে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যেরও অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপজেলা সম্মেলনে দলীয় পদ বাণিজ্যের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মহাস্থানহাটে অতিরিক্ত টোল আদায় করা নিয়ে বিরোধে তার লোকজন প্রকাশ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটিও জেলাজুড়ে বেশ আলোচিত।

এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নকাজের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীকে সুযোগ না দিয়ে তার নিজের লোকদের সুযোগ করে দিচ্ছেন। আর এ কাজে তিনি ইচ্ছেমতো টাকা হাতাচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা বলেন, রিপুর কারণে ক্ষমতাসীন দলে এখন নানা বিভক্তি। তিনি দলীয় নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন না করে নিজের লোক নিয়ে বলয় তৈরি করেছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডিসেম্বরে ঢাকায় বসছে এটিজেএফবি ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন

৩৪তম বিসিএস অল ক্যাডারের সভাপতি জয়, সম্পাদক জুয়েল

কালবেলার সাংবাদিকের বাবার ইন্তেকাল

টাইমস হায়ার র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষে

চট্টগ্রামে পেট্রলবোমায় দগ্ধ নারী মারা গেছেন

টানা ৪০ দিন নামাজ পড়ে সাইকেল উপহার পেল ১২ শিশু

পদ্মায় ভেসে এলো মৃত ডলফিন

পিসিএর সদস্য হলেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী 

ছাত্র অধিকার পরিষদ ছেড়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদে ১৩ নেতাকর্মী

জয়ে নেপাল মিশন শেষ করল নারী কাবাডি দল

১০

অন্তর্বাসে সোনা লেপে দেশে ফিরছিলেন দুবাই প্রবাসী

১১

কারও ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না : মুরাদ 

১২

‘ইসলামবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিলে চরম মূল্য দিতে হবে’

১৩

আ.লীগ নিষিদ্ধের কথা বললে সরকার পশ্চিমাদের দোহাই দেয় : সারজিস

১৪

নিজের জমিতেও টিউবওয়েল বসাতে পারছেন না রাজু

১৫

ওমানের কাছে হেরে এশিয়া কাপের বাইরে বাংলাদেশ

১৬

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপে যাচ্ছে ডিএনসিসি

১৭

‘গাবতলী টার্মিনালে আন্তঃজেলা বাস প্রবেশে আলাদা রোড নির্মাণ হবে’

১৮

উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানে ভয়াবহ বোমা হামলা

১৯

হেফাজতে ইসলামের উত্তরা জোনের প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল 

২০
X