প্রাচীন ও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক নিদর্শন রাজশাহীর বাঘা শাহী মসজিদ। ৫০০ বছর আগে বাংলার স্বাধীন সুলতান নুসরত শাহ সুন্দর কারুকার্যখচিত এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৫২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই ঐতিহাসিক মসজিদটি আজও আপন মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়।
বাংলাদেশের ৫০ টাকার পুরোনো নোট আর ১০ টাকার স্মারক ডাকটিকিটে দেখা মেলে প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই মসজিদের।
৫০০ বছরের পুরাতন এই শাহী মসজিদটি দেখতে দর্শনার্থীদের আনোগোনা সবসময় বিদ্যমান। মসজিদটির স্থাপত্যশৈলীর আকর্ষণে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন বাঘা উপজেলায়। এই মসজিদটি রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে বাঘা উপজেলা সদরে অবস্থিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মসজিদটি সমতলের আট থেকে ১০ ফুট উঁচু একটি বেদির ওপর নির্মিত। নিচে থেকে এটির দিকে তাকালে চোখ চলে যায় মসজিদের চৌচালা গম্বুজের দিকে। মসজিদে চমৎকার কারুকাজ আর টেরাকোটার নকশা পরিপূর্ণ। মসজিদের দক্ষিণ পাশ দিয়ে চলে গেছে বাঘা-ঈশ্বরদী সড়ক। সেখান থেকে উত্তর দিকে মুখ ফেরালেই মসজিদের ১০টি গম্বুজের কয়েকটি দৃশ্যমান হয়।
এরপর প্রধান ফটক থেকে এর নির্মাণশৈলী দর্শনার্থীদের টেনে নিয়ে যায় মসজিদের ভেতরে। ১০ গম্বুজের এই মসজিদে রয়েছে পাঁচটি দরজা। মাঝখানের দরজার ওপর ফারসি হরফে লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। চার কোনায় রয়েছে চারটি চৌচালা গম্বুজ, ভেতরে ছয়টি স্তম্ভ, চারটি অপূর্ব কারুকার্যখচিত মেহরাব। এর নকশায় রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী আম, গোলাপ ফুলসহ নানা রকম নকশা।
মসজিদের আঙিনা ঘিরে রয়েছে সীমানাপ্রাচীর। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ। দুপাশেই রয়েছে বিশাল দুটি ফটক। দক্ষিণ পাশের ফটকটি এখনো রয়েছে। সেখানেও রয়েছে দারুণ কারুকাজ। তবে উত্তর পাশের ফটকের অবস্থা আর আগের মতো নেই। এ ছাড়া মসজিদের সামনে খনন করা আছে বিশাল এক দিঘি।
মসজিদের সবখানে টেরাকোটার নকশা। কিছু কিছু জায়গায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নকশা প্রতিস্থাপন করেছে। সিরাজগঞ্জের টেরাকোটা শিল্পী মদন পাল কাজটি করেছিলেন।
মসজিদের উত্তর পাশে হযরত শাহদৌলা (র.) এবং তার পাঁচ সাথির মাজার অবস্থিত। এই মাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে হজরত শাহ (র.) এর পরিবারের মাজার। শাহী মসজিদ প্রাঙ্গণের বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে দুজন বাগদানী দরবেশের মাজার। এ ছাড়া এখানে আসা আরও অনেক সাধকেরও মাজারও আছে।
বাঘা শাহী মসজিদসংলগ্ন মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত হয় মহল পুকুর। ১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশে খননকাজের সময় একটি বাঁধানো মহল পুকুরের সন্ধান মেলে। সেটি একটি সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে অন্দরমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিন দিক থেকে বাঁধানো সিঁড়ি ভেতরে নেমে গেছে। সরকারি বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এখানে মানত করতে আসেন প্রচুর দর্শনার্থী।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল হান্নান মসজিদের গম্বুজ ভেঙে পড়ার কিছু তথ্য কয়েক বছর আগে দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে স্থানীয় অন্যান্য ঐতিহাসিক ইমারতের সঙ্গে বাঘা শাহী মসজিদেরও ক্ষতি হয়। ভেঙে পড়ে ওপরের ১০টি গম্বুজ। তার পর থেকে দীর্ঘদিন মসজিদের ভেতরটা পরিত্যক্ত ছিল।
একসময় ভেতরে টিনের ছাপরা তৈরি করে নামাজ চলত। পরে গম্বুজগুলো পুনর্নির্মিত হয়। ১৯৭৬ সালের ৩১ আগস্ট থেকে কাজ শুরু হয়, চলে ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত। এরপর ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নকশা প্রতিস্থাপন করে সিরাজগঞ্জের কারুশিল্পী মদন পালকে দিয়ে পুনরায় সংস্কার করে নেয়।
মসজিদটি দেখতে এসেছিলেন চারঘাট উপজেলার ঝিকড়া বাজার এলাকার বিপুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘জায়গাটা অনেক সুন্দর। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই জায়গার গুরুত্ব অনেক। তাই সময় পেলেই মাঝেমধ্যে এখানে বেড়াতে আসি।’
বাঘা মাজারের খাদেম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু কালবেলাকে বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তা ও এলাকার বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি কমিটি আছে। সেই কমিটি এই মসজিদ ও মাজার পরিচালনা করেন। প্রতি শুক্রবার এই মসজিদে অসংখ্য মানুষ নামাজ আদায় করতে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে।’
তিনি বলেন, ‘এই মসজিদ ঘিরে প্রায় ২৫৬ বিঘা জমির ওপর সুবিশাল দিঘি, আউলিয়াদের মাজার, মূল দরগাহ শরিফ ও জাদুঘর রয়েছে। শীতে অসংখ্য অতিথি পাখি আসে এখানে। ওই সময় দিঘির পাড়ে ভিড় করেন বহু দর্শনার্থী।’
বুধবার (২৭ মার্চ) দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর মসজিদটি পরিদর্শন করেন। তিনি পরিদর্শন বইয়ে লেখেন, ‘৫০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ স্থাপনাটি পরিদর্শন করি। ধর্মীয় ঐতিহাসকি স্থাপনা পরিদর্শন করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হলো।’
মসজিদের মোতয়াল্লি খোন্দকার মুনসুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই বছর মসজিদের বয়স ৫০০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা রয়েছে।’
মন্তব্য করুন