কথায় আছে ভাঁট ফুল ফুটলে তবেই প্রকৃতিতে বসন্ত আসে। বসন্ত তুলে ধরে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার পথের ধারে ঝোপ-ঝাড়ের প্রকৃতিতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে সাদা ফুলে হেসে উঠেছে ভাঁট। অযত্নে অবহেলায় ফুটে থাকা ভাঁট যেন বিশাল ফুলের তোড়া। চৈত্রের প্রথম থেকেই দেখা মিলছে এই ভাঁট ফুলের। এটাকে অনেকে বন জুঁই বা ঘেটু ফুল নামেও চেনে। তবে স্থানীয়রা বলছেন বর্তমান সময়ে ভাঁট আগের তুলনায় কম দেখা যাচ্ছে।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশও পড়েছিলেন ভাঁট ফুলের প্রেমে। তাইতো কবি তার ‘বাংলার মুখ’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/ বাংলার নদী মাঠ ভাঁট ফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, গোমতীর দুই পাড়, বন-বাদাড় ও উপজেলার বিভিন্ন মেঠোপথে পলাশ শিমুলের পাশাপাশি প্রকৃতিকে আরও রঙিন করে দিতে সৌন্দর্য মেলে ধরে থোকায় থোকায় ফুটে আছে ভাঁট ফুল। এই ফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে বিমোহিত হচ্ছেন নানা বয়সী মানুষ। ফুলের মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছেন ভাঁট ফুল। ভাঁট ফুলের সৌন্দর্যে প্রকৃতি যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে এবং স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বসন্তের অস্তিত্ব। কেবল ভাঁট ফুলই যেন বসন্ত বন্দনা হয়ে উঠেছে।
ভাঁট বা বনজুঁই একটি শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট ঝোপজাতীয় গুল্মশ্রেণির বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Clerondendron viscosum। এটি অতিপরিচিত একটি বুনো উদ্ভিদ। এর ফুল সাদার মধ্যে হালকা বেগুনি মিশ্রিত স্নিগ্ধ সুন্দর। ভাঁটফুল পাঁচটি পাপড়ি নিয়ে ফোটে থোকায় থোকায়। এ ফুলের গন্ধ রাতে তীব্র হয়ে ওঠে। এর আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশে। এটি কোনো পরিচর্যা ছাড়াই অনাদর ও অবহেলায় পথের ধারে, জলাশয়ের পাড়ে, বাড়ির আশেপাশে জন্মে ও বেড়ে ওঠে।
ভাঁট শুধু সৌন্দর্যই বিলায় না, এর রয়েছে ঔষধি গুণও। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে ভাঁট গাছের সবুজ পাতায় রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার। এতে মানবদেহের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফাইবার থাকার কারণে এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে সহায়তা করে। এর পাতায় অ্যান্টি-ডায়াবেটিক উপাদান আছে। এতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। এর পাতায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লোমেটরি উপাদান আছে বলে এটি শ্বাসযন্ত্রের রোগ নিরাময়ে সহায়ক। মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভাঁট গাছের পাতার জুড়ি নেই। হজমশক্তি বৃদ্ধিতেও ভাঁট গাছের পাতা ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও এর পাতা, বীজ ও ফল আদিকাল থেকেই আরও নানা রোগে ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নূর মোহাম্মদ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ভাঁটফুল ফুটলেই বোঝা যাবে প্রকৃতিতে বসন্ত প্রবেশ করেছে। বর্তমান সময়ে ভাঁটগাছ কম দেখা গেলেও এক সময় এই অঞ্চলে অনেক ভাঁট গাছ দেখা যেত। বসন্তে এদের নয়নাভিরাম ফুলের মুগ্ধতায় প্রকৃতি সুন্দর হয়ে ওঠে।
কলেজছাত্রী জান্নাতুল মাওয়া বলেন, কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ফুলগুলো দেখতে পাই, ভীষণ সুন্দর লাগে। এমন থোকা হয়ে ফুটে থাকে ফুলগুলো দেখলে মনে হয় যেন কেউ ফুলের তোড়া সাজিয়ে রেখেছে। বান্ধবীরা মিলে ভাঁট ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করি। প্রতি বসন্তেই এদের দেখতে পাই।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভাঁট ফুল প্রকৃতির অলংকার। এ সময়টায় ভাঁট ফুলই মনে করিয়ে প্রকৃতিতে এখন চলছে বসন্ত ঋতু। তবে আমাদের ছেলেবেলায় যত ভাঁটগাছ দেখেছি এখন আর এতটা চোখে পড়ে না। প্রকৃতির চিরন্তন রূপ ধরে রাখতে হলে ভাঁটগাছ সংরক্ষণে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষক আমির হোসেন বলেন, অযত্নে অবহেলায় জন্মানো ভাঁটগাছ পরিচর্যা ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠে। এটি একটি গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদ। বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম এই পুরো সময়টাতে এই গাছে ফুল ফোটে। ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবেও এটি খুব পরিচিত।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউনানি চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা বলেন, ভাঁট ঔষধি গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ঔষধি গাছ। এটি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের নানা রোগে ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি একটি বহুবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। প্রকৃতিতে ফাল্গুন মাস এলেই এই গাছে ফুল ফোটে। এতে পরিবেশে নতুন এক মাত্রা যোগ হয়।
মন্তব্য করুন