বগুড়ার প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শনের মধ্যে একটি হচ্ছে শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের খন্দকার টোলায় অবস্থিত খেরুয়া মসজিদ। স্থাপনার গায়ে স্থাপিত ফার্সি শিলালিপিতে লেখা আছে মসজিদটি নবাব মির্জা মুরাদ খান কাকশালের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত। মসজিদটি সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর মিশেলে নির্মিত। তবে এর নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি।
প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে নির্মিত এই খেরুয়া মসজিদের বর্তমানে সংস্কারের অভাবে বেহাল দশা দেখা দিয়েছে। মসজিদের তিনটি গম্বুজেই ফাটল ধরেছে। বর্ষা মৌসুমে ফাটলের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে বৃষ্টির পানি পড়ে মুসল্লিদের নানারকম বিড়ম্বনায় পোহাতে হয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঐতিহাসিক এই মসজিদের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার তিন যুগেও নতুন করে কোনো সংস্কার কাজ হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বর্ষাকালে নামাজ পড়তে গিয়ে ভিজতে হয়। বারবার প্রশাসনকে জানানোর পরও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তারা।
সবশেষ ৩৬ বছর আগে ১৯৮৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে মসজিদের সংস্কার কাজ করা হয়। এর আগে দীর্ঘ সময় গাছপালা জন্মে মসজিদের চারপাশে জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সংস্কারের পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদের ৪৮ শতক জায়গাসহ দেখাশোনার জন্যে আব্দুস সামাদ নামে এক স্থানীয়কে খাদেম হিসেবে নিয়োগ করেন। দীর্ঘ তিন যুগ ধরে তিনিই ঐতিহাসিক এ মসজিদের দেখাশোনা করে আসছেন।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে খন্দকার টোলায় অবস্থান খেরুয়া মসজিদের। পবিত্র রমজানে মাসে তারারির নামাজ ও ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই মসজিদে। মসজিদে তিনটি কাতারে ৯০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে এর বেশি হলে নামাজে অসুবিধা হয়। কারণ বাইরে বারান্দা বা নামাজের জায়গা নেই। তবে জুম্মার দিন এবং ঈদের দিন মাঠে চট বিছিয়ে নামাজের জায়গা তৈরি করা হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত বগুড়ার এই পুরাকীর্তি দেখতে প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত পর্যটক আসেন। উপজেলার প্রধান সড়ক থেকে খেরুয়া মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ও স্থাপনার সামনে ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পর্যটক আকর্ষণ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
প্রায় ৫৭ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২৪ ফুট প্রস্থের এই স্থাপনার শীর্ষে আছে সমান আকৃতির তিনটি গম্বুজ। চার কোনায় অষ্টকোণী মিনার। পূর্বে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে একটি করে, মোট পাঁচটি খিলানবিহীন প্রবেশপথ। দেয়ালের পুরুত্ব ছয় ফুট। মূল দরজার দুই পাশে দুটি ফার্সি শিলালিপির বামপাশেরটি অক্ষত।
অপরটি রাখা আছে পাকিস্তানের করাচি জাদুঘরে। ভেতরে আয়তকার ফ্রেমের মধ্যে অর্ধগোলাকার মেহরাব। কার্নিশগুলো বাঁকানো। বাইরের দেয়ালে কিছু ফুলের অবয়ব থাকলেও মসজিদের ভেতরের দেয়াল একেবারেই সাদামাটা। ছাদের চারপাশের খোপে অলৌকিক কবুতরের আবাস দখল করেছে শালিকের দল। মসজিদের সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা আয়তাকার মাঠ। মসজিদের কিনারা দিয়ে তাল, নারকেল, আম, কদমগাছের সারি। এক পাশে মৌসুমি ফুলের গাছও আছে। ইটের প্রাচীরের ওপর লোহার রেলিং দিয়ে পুরো চত্বর ঘেরা। মোট জায়গার পরিমাণ প্রায় ৫৯ শতাংশ। নামাজের সময় মুসল্লিরা ছাড়া সাধারণত কেউ ভেতরে প্রবেশ করে না।
খাদেম আব্দুস সামাদ বলেন, মসজিদটি পরিদর্শনে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষরা আসেন। দর্শনার্থীরা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়ে মুসলিম স্থাপত্য সর্ম্পকে ধারণা নিতে পারেন। তবে মসজিদে আসার সড়ক মেরামত আর আশপাশে বড় বড় ভবন নির্মাণ বন্ধ করা গেলে পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বাড়বে।
খেরুয়া মসজিদের মোয়াজ্জেম জোবায়ের বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি মসজিদে এখন তারাবির নামাজ ও ঈদের জামাত হয়ে থাকে। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মসজিদ সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। মসজিদের গম্বুজ ফুটো হয়ে বর্ষা মৌসুমে ভেতরে পানি আসে। দ্রুত সংস্কার না হলে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মন্তব্য করুন