একসময় ধান সংগ্রহের পর চাতালে শুকিয়ে হতো চাল প্রক্রিয়ার কাজ। এগুলোকে বলা হতো হাসকিং মিল বা চাতাল। শুধু চালই নয়, গম, ভুট্টা, সরিষাসহ বহু শস্য শুকানো হতো চাতালে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ধান ও চালের মূল্য এবং অটো রাইস মিলের কারণে লোকসানে পড়ে চাতালগুলো বিলুপ্তির পথে। তাই চাতাল ভেঙে কেউ কেউ গড়ে তুলছেন বাসা-বাড়ি, দোকানপাট। আবার কেউ কেউ গড়ে তুলছেন গরুসহ হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়ার খামার। এমন চিত্র দেখা যায় আদমদীঘি উপজেলাজুড়ে। চাতাল ব্যবসায় দুর্দিন চলায় মালিকরা ব্যবসা বদলাচ্ছেন।
চাতাল মালিকরা বলেন, আশির দশকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হাসকিং মিল-চাতাল তৈরি করে চালের ব্যবসা শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে ২৯৮টি চালকল। এর মধ্যে ২৮৪টি সাধারণ চালকল এবং ১৪টি স্বয়ংক্রিয় চালকল! চুক্তি ভঙ্গ করায় এর মধ্যে ৫২টি সাধারণ চালকল এবং ৩টি স্বয়ংক্রিয় চালকলের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমান ১১টি স্বয়ংক্রিয় ও ৫৪টি সাধারণ চাল কল রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে উপজেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার সাতশ টন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সর্বোচ্চ বড় খাদ্য গুদাম শান্তাহার সিএসডি ও সাইলো উপজেলায় এ ছাড়া প্রচুর ধান উৎপাদিত হয় ৯০ এর দশকের পর থেকে। এর পরে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো চালকল গড়ে ওঠে। অনেকে ফসলের জমিতেই চালকল স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করে। প্রথম ব্যবসায় ভালো মুনাফা হওয়ায় ২০০৪ সালে এই উপজেলা স্বয়ংক্রিয় চালকল চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ চালকলে ব্যবসা লাভজনক ছিল। কিন্তু ধান সিদ্ধ শুকানো ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় চালকলে সরাসরি কাঁচা ধান থেকে চাল দ্রুত বের হয়। এতে স্বয়ংক্রিয় চালকল চালু করে এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকশানে পড়ে একের পর এক সাধারণ চালকল বন্ধ হতে থাকে।
আদমদীঘি সদরে চাতাল মালিক আব্দুল জব্বার কালবেলাকে বলেন, তাঁর একটি সাধারণ চালকলে ১৫ দিনে ধান ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা ১৫৪ টন। প্রতিদিন ধানের প্রয়োজন ১৪০ বস্তা, প্রতি বস্তা ৭৫ কেজি।
কিন্তু শহরে বৈশাখী নামে স্বয়ংক্রিয় চালকলে ১৫ দিনে তিনটি ইউনিটের ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা ৪৮ হাজার টন। প্রতিদিন এই চালকলের ধানের প্রয়োজন হয় তিন হাজার টনের বেশি। উৎপাদন ক্ষমতার বিশাল ব্যবধান হাওয়ায় এবং লাভ কম হওয়ায় সাধারণ চাল কলগুলো ২৩ বছরে বন্ধ হয়ে যায়।
সাধারণ চালকলের মালিক হেলালুর রহমান বলেন, নানা কারণে স্বয়ংক্রিয় চালকল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা টিকে থাকতে পারছি না। এর অন্যতম কারণ হলো ধান থেকে স্যালু উৎপাদনের আনুপাতিক হার সাধারণ চালকলে প্রতি মণে ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয় ২৫ কেজি অথচ স্বয়ংক্রিয় চালকলে প্রতি মণে উৎপন্ন হয় ২৮ কেজি। সাধারণ চালকলে প্রতি মণ ধানে ১২ থেকে ১৫ কেজি তুষ উৎপন্ন হয় যার দাম অনেক কম।
পক্ষান্তরে স্বয়ংক্রিয় চালকলে ৬০০ মণ ধান থেকে চালের গুঁড়া বের হয় ৪০ বস্তা। প্রতি ৫০ কেজি ওজনের বস্তার মূল্য প্রায় দুই হাজার টাকা। চালের কুড়া থেকে ভোজ্যতেল, মাছসহ পশুখাদ্য তৈরি হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় চালকলের মালিকরা স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়ায় ধান কাটার পরপরই বেশি করে ধান কিনে রাখতে পারেন, যেটি সাধারণ চালকলের মালিকরা পারেন না।’
চাল ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন বলেন, বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় চাল তৈরি করে লাভ হচ্ছে না। প্রতি মণ ধান কেনাসহ উৎপাদন খরচ পড়ছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ টাকায়। প্রতি মণে লোকসান হচ্ছে দেড় থেকে দুইশ টাকা।
তিনি বলেন, দুইশর বেশি চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছেন। এসব শ্রমিক বর্তমানে বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা গোলাম রব্বানী বলেন, স্বয়ংক্রিয় চালকলের সংখ্যা বৃদ্ধি, ধানের দাম বেড়ে যাওয়া, মূলধন হারানোসহ বিভিন্ন কারণে সাধারণ চালকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মন্তব্য করুন