দেশে সারা বছর সেমাইয়ের যে বেচাকেনা হয় এর দুই তিন গুণ বেশি বেচাকেনা হয় রমজানও ঈদুল ফিতর মৌসুমে। এ সময়ে ঘরে ঘরে সেমাই খাওয়ার পুরোনো রেওয়াজ আজও বদলায়নি। তাই ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অন্য বছরের মতো এবারও ব্যস্ততা বেড়েছে কুমিল্লার বিসিক শিল্প নগরীসহ জেলার প্রায় ১৫টি সেমাই তৈরি কারখানায়। চিকনসাদা সেমাই তৈরিতে কারখানাগুলোতে শুরু হয় মালিক ও কারিগরদের কর্মযজ্ঞতা।
প্রতি বছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রমজান মাসে সাদা সেমাইয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে বলে এসময় এর উৎপাদনও বেড়ে যায়। প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ মণ সেমাই উৎপাদন করা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি জেলায় রপ্তানিও হচ্ছে এখানকার সাদা সেমাই। তাই কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা ঈদকে সামনে রেখে সাদা সেমাইয়ে বুনে সচ্ছলতার রঙিন স্বপ্ন।
কুমিল্লা বিসিকের ৬টি কারখানায় সেমাই উৎপাদন করা হয়। সেগুলো হচ্ছে, কুমিল্লা ফ্লাওয়ার মিল, মেট্রো কনফেকশনারি, খন্দকার ফুড, রিয়াজ ফ্লাওয়ার মিল, মক্কা কনজুমার অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস ও মালাই সুইটস। বিসিক ছাড়া কুমিল্লা আদর্শ সদর ও বিভিন্ন উপজেলায় সেমাই উৎপাদন করা হচ্ছে। ঈদ ঘনিয়ে আসায় কারখানাগুলোতে সেমাই তৈরি, রোদে শুকানো, খাঁচি ভর্তি করে বাজারে বিক্রির কাজে ব্যস্ত শ্রমিক ও মিলাররা। কুমিল্লার সাদা সেমাইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় জেলার বাইরেও পাঠানো হচ্ছে। সেমাই বেচাকেনা নিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও আড়তে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কুমিল্লার সেমাইয়ের গুণগত মান ভালো। জেলার চাহিদা মিটিয়ে চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালীসহ পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি জেলায় রপ্তানি হচ্ছে এখানকার সাদা সেমাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, গামলা ভর্তি ময়দা নিয়ে বসেছেন শ্রমিকরা। পাশেই বিদ্যুৎচালিত সেমাই তৈরির মেশিন। সেই ময়দা মেশিনের নির্দিষ্ট স্থানে ফেলছেন তারা। সময়ের ব্যবধানে মেশিনের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসে চিকন সেমাই। সদ্য তৈরি কাঁচা এই সেমাইগুলো নিপুণ দক্ষতায় মেশিন থেকে সংগ্রহ করে মুহূর্তেই রোদে ছড়িয়ে দিচ্ছেন স্টিকের মধ্যে অনেকে। এরপর সেগুলোকে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। আবার কয়েকজন নারী শ্রমিক এই শুকাতে দেওয়া সেমাইগুলো নেড়ে দিচ্ছেন এবং যেগুলো পুরোপুরি শুকিয়েছে বুঝতে পারছেন, সেগুলোকে পরবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সব শেষে তৈরি হওয়া সেমাই ওজন করে প্যাকেটে ভরে সিল করে নিচ্ছেন দোকানে পাঠানোর জন্য।
ঈদকে সামনে রেখে প্রত্যেক কারখানায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচশ কেজির মতো ময়দা থেকে সাদা সেমাই তৈরি করা হয়। এরপরিমাণ প্রায় ২৫-৩০ খাঁচি। সারা বছরই কমবেশি করে সাদা সেমাই তৈরি করা হয় এসব কারখানায়। তবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় রেকর্ড পরিমাণ সেমাই তৈরি করেন কারখানার মালিক-শ্রমিকরা। উৎপাদিত সেমাইয়ের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। তা কয়েকমাস বিক্রি করা যায়। এসব সেমাই বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে বেশি বিক্রি হয়ে।
কুমিল্লা ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, আমরা এক যুগ ধরে মানসম্মত উপায়ে সেমাই তৈরি করি। ঈদের মৌসুমে বেশি সেমাই উৎপাদন হয়। উৎপাদিত সেমাইয়ের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। তা কয়েক মাস বিক্রি করা যায়।
তিনি বলেন, সেমাই তৈরির কাঁচামাল তেল, ময়দা, বনস্পতি এসবের দাম দুই বছরে বেড়েছে চারগুণ। সেইসঙ্গে শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। তৈরির পরিবেশও স্বাস্থ্যকর করতে হয়। এতে প্রতি কেজি সেমাইয়ের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হচ্ছে কিন্তু সে হিসেবে বাজারমূল্য তেমন বাড়েনি। আবার আঞ্চলিক ব্র্যান্ডগুলোর জায়গা দখল করে নিয়েছে দেশের বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলো।
মহিউদ্দিন সেলিম আরও জানান, তার কারখানার সেমাই বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে বেশি বিক্রি হয়। বাংলা সেমাই চরাঞ্চলে বেশি বিক্রি হয়। বাংলা সেমাই আল-নূর ও কুলসুম নামে এবং লাচ্ছা সেমাই তানিন নামে বাজারজাত করেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসীর মামুন বলেন, সারা দেশে কুমিল্লার সাদা সেমাইয়ের কদর রয়েছে। সেমাইয়ের গুণগত মান ভালো হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বাজারে সরবরাহ করা হয়। আর গুণগত মান ঠিক রাখতে মিল মালিকদের কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আমরাও নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন করি।
মন্তব্য করুন